ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুল ইসলাম সুমন

মোহাম্মদ হানিফ ॥ স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

মোহাম্মদ হানিফ ॥ স্মরণ

ঢাকার রাজনীতির প্রাণপুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধণী’ নামে ডাকত। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আলহাজ মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। পুত্র আলহাজ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। মোহাম্মদ হানিফ আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমতনির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান-ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল সজ্জন ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দেয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের বাসায় অবস্থান নেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা, নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয়দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয়দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে তিনি রাজপথে সংগ্রামের প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া ঢাকা ১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের মহান দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মোহাম্মদ হানিফের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যের নির্মম হত্যাকা-। ১৯৭৩ সালে লন্ডনে একসঙ্গে সফরে থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুই আমার রাসেলকে দেখবি’Ñ বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে করতেন মোহাম্মদ হানিফ। তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের পর মোহাম্মদ হানিফের কণ্ঠে ছিল শুধুই সেøাগানÑ ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম মুজিব হত্যার বদলা নেব, রাসেল হত্যার বদলা নেবো’। ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিকভাবে পিতা মুজিব হত্যার বদলা নেয়া এবং হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়েছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাকমঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসাতেও কোন ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ। আজ ২৮ নবেম্বর তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির এক চরম দুঃসময়ে। তাঁর মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। দেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। একজন সফল রাজনীতিবিদ এবং নানা গুণাবলীর অধিকারী মোহাম্মদ হানিফ তাঁর কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন
×