ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নজরুল সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

নজরুল সম্মেলন

বাঙালীর বাঙলার মধ্যে নিহিত ছিল তাঁর আত্মার বীজ। তাই বাংলা মায়ের রূপটি তিনি দেখতে পেয়েছেন গভীর মমত্ববোধ থেকে। তাঁর সৃষ্টিতে সেসব বাঙময় হয়ে আছে আজও। বাংলার আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, ঘাট, হাট, বাট পেরিয়ে বাঙালীর পর্ণকুটিরে দরিদ্র, শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, সর্বহারা মানুষের কাছে তিনি প্রতিভাত হন বিদ্রোহী রূপে। উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল, অত্যাচারীর খড়গ কৃপান ভীম রণভূমে মুছে দিয়ে এক শান্তি, স্বস্তি ও সুখের বাংলাদেশই তিনি চেয়েছিলেন, যে দেশ ফুলে ও ফসলে, কাদামাটি জলে ভরে থাকে লাবণীতে। বাংলার সব কিছুই যেন তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে উঠত দোদুল দুলে। পদ্মার ঢেউ, গোমতীর শান্তরূপ, যমুনার নীল জল, মেঘনার মাঝিÑ সবই তাঁকে টেনে নিত স্নিগ্ধমায়ায়। নদীমাতৃক পূর্ব বাংলাকে ভালবেসেছিলেন বলেই জীবনসঙ্গিণী বেছে নিয়েছিলেন এখান থেকেই। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ মিলিয়ে তাঁর যে বাংলা, যে দেশের জন্য তাঁর হৃদয় উদগ্রীব হয়ে থাকত। জননী জন্মভূমি ছিল স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। কিন্তু তাঁর সেই দেশ ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে হয়ে গেছে ভাগ। এপার বাংলা, ওপার বাংলার মধ্যখানে জেগে উঠেছে যখন চর, তখন নজরুল বাকরুদ্ধ, অসুস্থ। তাই দ্রোহের স্বর বেজে ওঠেনি। জীবন সায়াহ্নের শেষ ক’বছর কেটেছে তাঁর এই বাংলাদেশে। বাংলার মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। সেই মুক্তি পেয়েছে বাঙালী ১৯৭১ সালে সশস্ত্র লড়াই করে। এই বাংলায় তার সমাধিস্থল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তাই জেল, জুলুম তাঁকে বরণ করতে হয়েছে। কারার লৌহ কপাট, শাসকের শিকল ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছেন বার বার। শাসক ইংরেজরা তাঁর ক্ষুরধার লেখনীকে স্তব্ধ করে দিতে তাঁর গ্রন্থ নিষিদ্ধ করেছে যেমনি, তেমনি তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় যেখানেই কবি দেখেছেন মানবতার দুর্গতি, সেখানে দাঁড়িয়েছেন তিনি রুখে। তাঁর তরবারি বিদ্যুতদীপ্তের মতো ঝলমল করে উঠত। নতুন যুগের মিনারে দাঁড়িয়ে আলোক নিশান বরদার হয়ে সাম্যের গান গেয়েছিলেন। তাই সুরে ও বাণীতে বাংলার চারণ কবি নজরুল। সাম্যবাদী কবি। ফরিয়াদী কবি তিনি। আর সেসব ছাপিয়ে পরিচয় তাঁর দাঁড়িয়ে গেছে বিদ্রোহী কবি হিসেবে। জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে যেখানে আজও ভুল বোঝাবুঝি, হানাহানি, খুনোখুনি চলে, যেখানে চলে শাস্ত্র-শকুন, ধর্মান্ধ জঙ্গীদের স্বার্থের বেসাতি, সেখানেই নজরুল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। তিনি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই কথা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মানুষই ছিল কবির ধ্যান-জ্ঞান। তাই দেখা যায়, মানুষ হিসেবে, মানুষের কবি হিসেবে নজরুলের যে আবেদন এবং অবদান তা চিরস্মরণীয়, চিরকালীন। নজরুল ছড়িয়ে গেছেন সবখানে। সমগ্র মানব জীবনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছেন কবি। তাই তিনি সর্বকালের সর্বদেশের। এই নজরুল অবিভক্ত। সর্বকালীন। কালাতীত। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অন্নদাশংকর রায় সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেনও, সবকিছ ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নি নজরুল। তাই নজরুল দুই বাংলাজুড়েই বিদ্যমান। নজরুল জীবদ্দশায় অবহেলা যেমন পেয়েছেন, অসুস্থতার পরও ছিলেন অনেকখানি অবহেলিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে সম্মানিত করেছেন যেমন, তেমনি কবির মহিমাকেও তুলে ধরেছেন। বাংলার সবপ্রান্তরসহ সকল বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে তিনি স্বগরিমায় মহীয়ান। আর সে কারণেও গানে আর কথামালায় ‘বাংলাদেশ-ভারত নজরুল সম্মেলন চলছে সাত দিনব্যাপী। দু’দেশের মধ্যে নজরুল চর্চা ও গবেষণা বিনিময়ের লক্ষ্যে তিনটি জেলায় চলছে অনুষ্ঠানমালা। নজরুল ইনস্টিটিউটও তিন দিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলনের আয়োজন করেছে তিনটি জেলায়। বাঙালী-অন্তপ্রাণ নজরুলের সৃষ্টি বাঙালীর অন্তরে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ুকÑ সেই প্রত্যাশা সবার। তাঁর চেতনা যুগে যুগে চির ভাস্বর হয়ে থাকুক মানুষের হৃদয়ে।
×