ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে অসহিষ্ণুতা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৫

ভারতে অসহিষ্ণুতা

ভারত মহাত্মা গান্ধীর দেশ। মহাত্মা গান্ধীই গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অহিংসার নীতি। যদিও আজ ওই মহান নেতার মাতৃভূমিতে লতিয়ে উঠছে বিদ্বেষের বিষবাষ্প। কয়েকজনকে এই বিষবাষ্পে প্রাণ হারাতে হয়েছে। অথচ ভারতের সংবিধানই নাগরিকের মতামত প্রকাশ করার, চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের কথা বলার, নিজস্ব ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিয়েছে। আজ সেই স্বাধীনতার টুঁটি টিপে ধরা হচ্ছে। ভারতের বহুত্ববাদ আজ নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ। ২০১৪ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতার আসার পর থেকে দেশটিতে অসহিষ্ণুতার পালে যে হাওয়া লেগেছে তা যেন আর থামছেই না। অভিযোগ যে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে উঠছে তা নয়। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসবিদ থেকে বিজ্ঞানী এমনকি বহির্বিশ্বের নানা দেশ ও নেতৃত্ব। তারা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। খেতাব-পদ ত্যাগ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী। সেই ভিতর থেকেই প্রতিবাদ হচ্ছে নানা উপায়ে। এর সর্বশেষ সংযোজন বলিউড মহাতারকা আমির খানের উদ্বেগ প্রকাশ। ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে অসহিষ্ণুতা ছড়ানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লীতে ভারতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শুরুতেই যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় তার কেন্দ্রে ছিলেন আমির খান। পরদিন শুক্রবার দেশটির মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে প্রসঙ্গটি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাদানুবাদের জের ধরে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে তুলে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং কদর্য বাক্যবাণে বিদ্ধ করার মতো ঘটনা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ৩৫ শতাংশেরও বেশি। অথচ সেখানে তাদের কর্মসংস্থান অতি সামান্য। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে ৩১ শতাংশের বেশি মুসলমান হলেও কংগ্রেস আমলে তো বটেই, কমিউনিস্ট শাসনামলেও তাদের কর্মসংস্থান থেকেছে ২ শতাংশেরও কম। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলেও এদিক দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে সংবেদনশীল মানুষের এমন অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক বলেই মনে হয় যে, ভারতে এখন সমস্ত মানুষ ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি মাত্র অবস্থানে। উভয় অংশটি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষ। যে কোন অন্য মতকেই মনে হচ্ছে বিরোধিতা এবং যে কোন বিরোধিতাই যেন ধ্বংসযোগ্য। অথচ প্রকৃতির নিয়ম এমন নয়। বিচিত্রতাই প্রকৃতির শক্তি। অসংখ্য বৈচিত্র্যের বিপুল সহাবস্থানের কারণেই নানা প্রতিকূল অবস্থায়ও প্রকৃতি টিকে থাকে। মানুষ প্রকৃতিরই এক সংস্থান, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী কোন অবস্থানে সে রক্ষা পাবে না। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সেদেশের জনগণ ধর্মীয় ও সামাজিক নির্যাতন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। শাসক শ্রেণীর কর্মকা-ের বাইরে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এর ফলে ভারতে শাসকশ্রেণীর ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক নির্যাতন থাকলেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে, প্রতিরোধ আছে। ঐতিহ্যগতভাবে ভারতে সেটা যে এখনও আছে- তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সমাজের সৃষ্টিশীল ও সংবেদনশীল অংশের স্পষ্ট প্রতিবাদ এবং ইতিবাচক মত প্রকাশের মধ্য দিয়ে। নেহরু পরিবারের একজন, ভারতের সাহসী কলমযোদ্ধা নয়নতারা সহগল মোক্ষম কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন যা উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি বলেন, ‘ভারত যে শুধু হিন্দুদের দেশ নয়, সবার সেটা গলা তুলে বলার সময় এসেছে। ভারতের সব মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে, তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সরকারের এটা প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রত্যেকটি ধর্মের নিজস্ব জায়গা আছে, সম্মান আছে। এই বহুত্ববাদই আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অলঙ্কার। তার ওপর যদি খাঁড়া নেমে আসে, তবে যে কোন মূল্যে তাকে রক্ষা করতে হবে।’ প্রতিবেশী মিত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ আশা করে নানা টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে পরধর্ম সহিষ্ণুতার দিকটি অবশ্যই বিজয়ী হবে।
×