ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা

সাগরে বালু উত্তোলন

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৯ নভেম্বর ২০১৫

সাগরে বালু উত্তোলন

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রাসারণ কাজের নামে সমুদ্রের মোহনা থেকে বালু উত্তোলন করে চলছে কতিপয় অসাধু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট। এতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছে বাঁকখালী অববাহিকা ও সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকা। বিমানবন্দর সম্প্রাসারণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কতিপয় স্থানীয় ব্যক্তি প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা না করে বাঁকখালী নদীর মোহনা-মহেশখালী চ্যানেল ও নাজিরার টেক সমুদ্র এলাকাসহ প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন একাধিক পয়েন্ট থেকে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে তারা। এতে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হতে চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজের টেন্ডার পাওয়া কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ইউনিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, সিউকে ওয়াং ডেভেলপমেন্ট কোং লি., হ্লা কর্পোরেশন লি., জেভি ও এদের সহযোগী বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লি. জয়েন্টভেঞ্চারে বিমানবন্দর উন্নয়নের কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন চূড়ান্তভাবে। টেন্ডার ও ওয়ার্ক পারমিটে সিলেটের পাথর, ছোট নুড়ি পাথর ও সিলেটের বালু ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও তারা নিয়মবহির্ভূত সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে দেদার উত্তোলন করছে সাগরের মূল্যবান খনিজ বালু। সিলেটের বালুর পরিবর্তে লবণাক্ত সামুদ্রিক বালু ব্যবহার করায় কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজের গুণগতমান ও স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানা যায়, পৌরসভার সমিতিপাড়া পয়েন্ট, নাজিরার টেক ও বাঁকখালী নদীর মোহনায় উপকূল থেকে অন্তত ২শ’ মিটার দূরে সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। পাশপাশি ওই বালু পাইপলাইনের মাধ্যমে স্থলভাগে নিয়ে আসছে। রাত-দিন ১০ চাকার বিশালাকার ট্রাকে করে পরিবহন করা হচ্ছে এসব বালু। এতে সমুদ্রের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাকৃতিক জীব সম্পদ, মৎস্য, চিংড়ি, শামুক-ঝিনুক, ডলফিন, বিভিন্ন জাতের কাকড়া, সী-উইড, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, এনাড্রস জাতের প্রাণী, ক্যাটাড্রমাস প্রজাতি, সেডেন্টারি প্রজাতি, জু-প্লাংকটন এবং ফাইটোপ্লাংকটনসহ বিভিন্ন জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন-আবাসস্থল বিনষ্ট হতে চলছে। এভাবে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের ইকো-সিস্টেমকে বিপর্যস্ত করে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে অনায়াসে। এছাড়া সমুদ্রতল, জলরাশি, জলস্রোত, বায়ু, সামুদ্রিক প্রবাল-প্রাচীরও দূষিত হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ২৭৪৯(২৫) নাম্বার সিদ্ধান্ত এবং জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জ্যামাইকা কনভেশনে সাধারণ পরিষদের ১৫১৪(১৫) নাম্বার সিদ্ধান্ত, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন-১৯৯২, রামসার কনভেনশন-১৯৭১-এ সুস্পষ্ট উল্লেখ আছেÑ সমুদ্রের ইকো সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করে কোন প্রকার ড্রেজার বসিয়ে মাটি, বালু উত্তোলন করতে পারবে না। জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ও জ্যামাইকা কনভেনশনে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। জাতীয় পরিবেশ নীতিমালা-১৯৯২ এর ৩(১০)ধারা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম এবং সম্পদের পরিবেশসম্মত সংরক্ষণ, উন্নয়ন, দূষণরোধ করার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধনী-২০১০ এর ৬(ঙ) ও ১৬ ধারা মোতাবেক সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা সরাসরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনের কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সিন্ডিকেট সদস্যরা। এ ব্যাপারে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মৎস্যরক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ এর ২ ও ৩ ধারা, মৎস্যরক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি-১৯৮৫, বিভিন্ন উপবিধি এবং সামুদ্র্রিক মৎস্য ক্ষেত্র অধ্যাদেশ-১৯৮৩ একাধিক ধারা অনুযায়ী নদীর মোহনা সমুদ্রের মৎস্য প্রজনন ও আবাসস্থল এলাকায় বালু উত্তোলন করতে মৎস্যসহ জীবন্ত সামুদ্রিক সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। তারপরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লি. সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে হরদম সামুদ্রিক বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (সদর) ড. মঈন উদ্দিন আহমদ জানান, সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কক্সবাজার আনবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমালা অনুযায়ী খনিজ সম্পদ ও সামুদ্রিক খনিজ বালু পারমাণবিক শক্তি কমিশন ছাড়া আর কেউ উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারে না। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সাধন কুমার মোহন্ত জানান, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য একটি দেশীয় এবং ৩টি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে, তারা সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজার মেশিন ক্রয় করেছে শুনেছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী জানান, সিলেটের বালু দিয়ে নির্মাণ কাজ করার কথা থাকলেও আমরা সস্তায় ও কম খরচে সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে সহজেই বালু উত্তোলন করে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, এ পর্যন্ত কোন প্রকার প্রশাসনিক বাধা-নিষেধ আসেনি।
×