ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের শিল্পীরা মাতালেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাসরের প্রথম প্রহর

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৫

দেশের শিল্পীরা মাতালেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাসরের প্রথম প্রহর

মনোয়ার হোসেন ॥ ক্রমেই যেন সঙ্গীতের তীর্থভূমিতে পরিণত হচ্ছে রাজধানী। নানা অসহিষ্ণু অপতৎপরতার মাঝেও অসুরের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে সুরের প্রতিবাদ। এই নবেম্বর মাসেই নিরাপত্তার ঝুঁকিকে পাশ কাটিয়ে শ্রোতার স্বতঃস্ফূর্তায় শহরে অনুষ্ঠিত হলো তিনটি বৃহৎ সঙ্গীত উৎসব। সেই ধারাবাহিকতায় চলছে এখন বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। শ্রোতার আকাক্সক্ষায় তিন রাত্রি পেরিয়ে পঞ্চরজনীতে গড়ানো ধ্রুপদী সঙ্গীতাসরটি পরিণত হয়েছে সুররসিকদের প্রাণের উৎসবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি জেগে থাকে উৎসব প্রাঙ্গণ আর্মি স্টেডিয়াম। সুখের ঘুমকে ফাঁকি দিয়ে সুরের আবেশে নিজেকে সমর্পিত করছেন হাজার হাজার শ্রোতা। বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে উৎসর্গকৃত বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাসরের তৃতীয় দিন ছিল রবিবার। এদিন বিশ্ববরেণ্য ধ্রুপদী শিল্পীদের পাশাপাশি আসর মাতালেন দেশের শিল্পীরা। জানিয়ে দিলেন পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। এবারের উৎসবে প্রতিদিনের অধিবেশনই শুরু হচ্ছে এদেশের শিল্পীদের পরিবেশনা দিয়ে। সেই সূত্রে তৃতীয় রজনীর অধিবেশনের সূচনা হয় ওয়ার্দা রিহাব ও তার দলের পরিবেশনা দিয়ে। দর্শক-শ্রোতাদের নয়ন ও অন্তরে প্রশান্তি ছড়িয়ে উপস্থাপিত হয় মণিপুরী নৃত্য। অনবদ্য নৃত্যশৈলীতে শিল্পীরা রাঙিয়ে দেন এদিনের উৎসবের প্রথম প্রহরটি। ওয়ার্দা রিহাবের নেতৃত্বাধীন দলটি পরিবেশন করে মণিপুরী নৃত্যালেখ্য লেচান, কথক চাবা, বসন্ত, গোষ্ঠ ক্রীবা ও জয় জয় দেবা। পরিবেশনা শেষে ওয়ার্দার হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন চিত্রশিল্পী রণজিৎ দাস। ৩৫ মিনিট ব্যাপ্তির বর্ণাঢ্য পরিবেশনায় অংশ নেন ঢাকা ও সিলেটের ৩৫ মণিপুরী নৃত্যশিল্পী। ‘লেচান’ পরিচালনা করেন ভারতের মণিপুরী নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক বিম্বাবতী দেবী। এই শিল্পী কিংবদন্তি নৃত্যগুরু বিপিন সিংহ ও কলাবতী দেবীর কন্যা। মণিপুরী নৃত্যরসে অংশ নেন শিল্পী বদরুল আলম চৌধুরী, দিল আফরোজ জাহান, ফুলেশ্বরী পারমিতা, রাকা পল, রুবাইয়্যাত সাইয়েদা, রুবাইয়্যাত তৈয়েদা, পুষ্পিতা হোসাইন, তাসনিম শারমিন, বাসনিন হাসিন, এমএ হোসেন, অনিন্দিতা রায়, অন্তর দেওয়ান, মাহরিমা শারমিন, তৃণা মজুমদার, শাচিন মং মারমা, তনুজা আইয়ুব তান্নি, মোবাশ্বেরা মাহবুব, নাফিসা ইসলাম, জয়তী দত্ত, সুমাইয়া আহমেদ, তাসমিয়া তাবাসসুম, হুমায়রা হায়দার, সুরভী মোদক, হান্নান শাহ, তমা দাস, এসএম রায়হানুল আলম, শাপলা খাতুন, জয়িতা দাশ, বাশারাত শায়রা প্রমুখ। তৃতীয় অধিবেশনের তৃতীয় পরিবেশনা নিয়ে উৎসব মঞ্চে আসেন ভারতের ধ্রুপদ ঘরানার ডাগর পরিবারের জুনিয়র ব্রাদার্স খ্যাত শিল্পী ওস্তাদ ওয়াসিফ ডাগর। ২০১০ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত এ শিল্পী সুরের মোহময়তায় তন্ময় করে রাখেন শ্রোতাদের। শিল্পীর সঙ্গে পাখোয়াজে সঙ্গত করেন মোহন শ্যাম শর্মা এবং তানপুরায় গোপেশ গৌড় ও সন্তোষ কুমার। শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। বাবা ওস্তাদ ফুলঝুরি খান এবং বড় ভাই ওস্তাদ ইউনুস খানের পথরেখা অনুসরণ করে এদিন সরোদে বৈভবময় রাগ-রাগিণীর সুর তুলে সঙ্গীতানুরাগীদের আপ্লুত করেন বাংলাদেশের ইউসুফ খান। পরিবেশন করেন রাগ কিরওয়ানী। এই শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত দেন ইফতেখার আলম প্রধান ও তানপুরায় তাহিয়া খান। ইউসুফকে উৎস স্মারক প্রদান করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের লিটু। সরোদের শব্দতরঙ্গ থামতেই উৎসব প্রাঙ্গণে বয়ে যায় বেহালার সুমধুর সুর। রাত সাড়ে ১০টায় মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের প্রখ্যাত বেহালাবাদক ড. এন রাজম। টানা প্রায় দেড় ঘণ্টার অনবদ্য পরিবেশনায় ঘোর লাগিয়ে দেন এই শিল্পী। কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন বেহালায় রাগ রাগিণীর খেলা। চারটি বেহালায় সুরের ঝঙ্কার তুলেছেন চারশিল্পী। তারা তিন প্রজন্মের চার বেহালাবাদক। মধ্যমণী ছিলেন ‘সিংগিং ভায়োলিন’ বা ‘সুকণ্ঠী বেহালা’ হিসেবে স্বীকৃত শিল্পী রাজম। তার সঙ্গে বেহালায় সুর তোলেন মেয়ে সঙ্গীতা শংকর এবং দুই নাতনী রাগিণী শংকর ও নন্দিনী শংকর। মুকুন্দরাজ দেওয়ের তবলার বোলের সঙ্গে তিন প্রজন্মের এই চারশিল্পীর বেহালা বাদন সুরের সাগরে অনুরণন তোলে। প্রথমেই তারা পরিবেশন করেন রাগেশ^রী রাগ। এরপর বানারসী ঠুমরী। পরিবেশনার এক পর্যায়ে এন রাজম একই রাগ কণ্ঠে এবং বেহালায় কেমন শোনায় সেটা পরিবেশন করে দেখান। অনবদ্য তার বাদন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার পরিবেশান উপভোগ করেন সবাই। এরপর চারশিল্পী বেহালায় পরিবেশন করে শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘ব্রজগোপী খেলে হোলি’ গানটি। বেহালায় গানটি শুনে শ্রোতারা হন আলোড়িত। তার বজনার মধ্য দিয়ে অপার্থিব ও স্বগীয় এক আবেশে ছড়িয়ে পড়ে আর্মি স্টেডিয়ামে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য এবারই প্রথম। পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সম্মাননায় ভূষিত এই শিল্পী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে অন্যতম গুণী বেহালা শিল্পী হিসেবে স্বনামধন্য।। এন. রাজমের বাদলার শেষে খেয়াল পরিবেশন করেন বিদুষী শ্রুতি সাদোলিকার। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন অনীশ প্রধান ও হারমোনিয়ামে সুধীর নায়েক। গত বছরের উৎসবেও মৃদঙ্গ বাজিয়ে শ্রোতাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন কর্ণাটকী মৃদঙ্গম শিল্পীগুরু কড়াইকুডি মানি। এবারও হলো না তার ব্যতিক্রম। মধ্যরাতে শব্দের নিনাদ তুলে মাতালেন রাতজাগা সুরপিপাসীদের। সেই মুগ্ধতার প্রতিউত্তরে শ্রোতা-দর্শকরা আপন আসনটি ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালির দিয়ে অভিবাদন জানান শিল্পীকে। তৃতীয় অধিবেশনের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন তিনি। কড়াইকুডি মানির সুর-লহরীতে খঞ্জিরা বাজান অমরিত এন এবং ঘটমে সঙ্গত করেন শিল্পীকে সুরেশ বৈদ্যনাথন। তৃতীয় অধিবেশনের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল খেয়াল। পরিবেশন করেন হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, খেয়াল, ঠুমরী, দাদরা পাশাপাশি ভারতীয় পপসঙ্গীতের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শুভা মুডগাল। পদ্মশ্রী ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন অনীশ প্রধান ও হারমোনিয়ামে সুধীর নায়েক। আজ মাতাবেন ওস্তাদ জাকির হোসেন ॥ উৎসবের চতুর্থ দিন আজ সোমবার মধ্যরাতে মঞ্চে উঠবেন উপমহাদেশ তথা বিশ্বের কিংবদন্তি তবলিয়া ওস্তাদ জাকির হোসেন। তবলা আর জাকির হোসেন যেন সমার্থক শব্দ। এবারই প্রথম এ উৎসবে এলেন তিনি। বরেণ্য এ শিল্পীর তবলার লহরি শোনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন সমঝদার শ্রোতারা। তার বাবা ওস্তদ আল্লা রাখাও ছিলেন বিখ্যাত তবলাবাদক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওস্তাদ আল্লা রাখা নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে বাঙালীদের সাহায্যার্থে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ তবলা পরিবেশন করেন। তার সুযোগ্য সন্তান জাকির শৈশব থেকেই তবলা বাজানোয় অর্জন করেন অসমান্য দক্ষতা। অল্প বয়সেই ‘শিশু বিস্ময়’ হিসেবে আবির্ভূত হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তবলা বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯ বছর বয়স থেকে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তখন থেকেই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু। বছরে ১৫০ কনসার্টে যোগ দিয়ে গড়েছেন রেকর্ড। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে তার একক তবলা বাদনের মধ্য দিয়ে আজকের পরিবেশনা। আজকের অন্যান্য পরিবেশনা ॥ আজ সোমবার উৎসবের চতুর্থ দিন। আজও উৎসব শুরু হবে নৃত্যের মধ্য দিয়ে। এদিন শুরুতেই কুচিপুডি নৃত্য নিয়ে মঞ্চ মাতাতে উঠবেন দম্পত্তি শিল্পী গুরুরাজা ও রাধা রেড্ডি। এরপর কর্ণাটকি বেহালা পরিবেশন করবেন গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালন। তারপর বাজবে সন্তুরের ঝঙ্কার। বাজাবেন বিগত আসরগুলো সন্তুরের সুরে শ্রোতাদের মাতানো শিল্পী প-িত শিবকুমার শর্মা। আগের আসরের রেশ ধরে ঝাকড়া সফেদ চুলের এই বিখ্যাত এই শিল্পী এ আসরেও নিজেকে উজার করে দেবেনÑ এমনটাই প্রত্যাশা করছেন শুদ্ধ সুরের অনুরাগীরা। এদিন সরোদ পরিবেশন করবেন প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। এরপর খেয়াল পরিবেশন করবেন প-িত উলহাস কশলকর।
×