ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ আবু সাঈদ শিমুল

হাত ধোয়াতে রোগমুক্তি

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ১ ডিসেম্বর ২০১৫

হাত ধোয়াতে রোগমুক্তি

হাত ধোয়া দিবসের কথা শুনে সেদিন একজন তো হেসেই খুন,“হাত ধোয়ারও দিবস আছে নাকি? প্রশ্নটার মাঝে কৌতূহল বা বিস্ময় যত না ছিল তাঁর চেয়ে বেশি ছিল সেøস বা বিদ্রƒপ। অথচ হাত ধোয়া কিন্তু খুবই প্রয়োজনীয় । আমাদের একটি হাতের মাঝে যে পরিমাণ জীবাণু থাকে তা সারিবদ্ধভাবে রাখলে পুরো এশিয়া মহাদেশের সমান আয়তন হবে! এর বেশিরভাগই ক্ষতিকারক নয়। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু হাত ধুলে পেটেরপীড়া কমে ৩৯ ভাগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগবালাই কমে ৫০ ভাগ। সিডিসির অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, খাবার ও পানির মাধ্যমে যেসব রোগ ছড়ায় তার প্রতি চারজনের একজন আক্রান্ত হন শুধু হাত না ধোয়ার কারণে। পরিসংখ্যানের এই কচকচানি যদি বাদই দিই তবুও সাদা চোখে এটা বলাই যায়, হাত না ধুলে জীবাণুরা আমাদের নাজুক দেহে হামলা শুরু“করবে, আর আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দপতন ঘটে নেমে আসবে ভোগান্তি। তার চেয়ে হাত ধোয়ার মতো সহজ অভ্যাসটুকু গড়ে তুললে সব ভোগান্তি আর রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারি। হাত ধোয়া এত জরুরী জেনেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মানুষের হাত ধোয়ার হার শূন্য থেকে চৌত্রিশ শতাংশ। অনেকেই মনে করতে পারেন গরিবরা কম হাত ধোয় আর ধনীরা বেশি, অথচ আমেরিকার অনেক মানুষই কিন্তু হাত ধোয় না। আমেরিকান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার মতো সভ্য দেশে হাত না ধোয়ার কারণে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ লোক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। হাত না ধোয়ার কারণে তাদের প্রতিবছর চিকিৎসা খাতে খরচ হয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের টাকায় কয়েকশ’ কোটি টাকা। হাত ধোয়া কিন্তু শিশুদের জন্য খুবই জরুরী। প্রতিবছর ৫ বছরের নিচের ৩.৫ মিলিয়ন শিশু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় মারা যায়। শিশুরা যদি হাত ধোয় এবং শিশুদের খাবার তৈরি করতে যদি অভিভাবকরা হাত ধুয়ে নেন, তবে এ মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমানো যায়। পাকিস্তানে এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার ফলে শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ অর্ধেক কমে গেছে। হাত ধোয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয় ডায়রিয়া পরিস্থিতির। বিশ্বজুড়ে সঠিক নিয়মে হাত ধুলে ডায়রিয়াজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নেমে আসবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু হাত ধুলেই শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার উদ্যোগ সফল হবে। নিয়মিত হাত ধুলে বিভিন্ন কৃমি বিশেষ করে এ্যাসকেরিয়াসিস ও ট্রাইচুরিয়াসিসের সংক্রমণ কম হয়। হাত ধুলে চোখের রোগ ট্রাকোমা এবং ত্বকের রোগ ইমপেটিগো কম হয়। যারা খাদ্য বিক্রি, সরবরাহ ও রান্না করেন তাদের হাত পরিষ্কার রাখা খুবই দরকার। কারণ তাদের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকাদেরও হাত ধোয়া জরুরী। হাত ধোয়া বেশি প্রয়োজন, যখন আমরা শিশুর জন্য খাবার বানাই ও খাই তার আগে। যখন কোন অসুস্থ মানুষের কাছে যাই, তার পরিচর্যা করি, শিশুদের পরিচর্যা করি, কোন কাটা অংশের পরিচর্যা করি তার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। আবার মলমূত্র ত্যাগের পর, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, বাইরে বেড়াতে যাওয়া, অফিস থেকে আসা, হাঁচি-কাশি দেয়া, অসুস্থ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত করে আসার পর হাত ধোয়া উচিত। ক্ষত ধোয়া, জীবজন্তু ঘরে পোষা হলেও তাদের ধরার পর হাত ধুতে হবে। বাচ্চাদের মলমূত্র পরিষ্কারের পরও হাত ধোয়া জরুরী। হাত ধোয়ার কিন্তু কিছু নিয়ম আছে। শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলে বাহ্যিকভাবে পরিষ্কার হয় সত্যি, কিন্তু জীবাণুমুক্ত হয় না। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর সাবান, লিকুইড সোপ ও হ্যান্ড রাব বেশি কার্যকর। হাসপাতাল ছাড়া সাধারণ গৃহস্থালি, অফিস-আদালতে হাত জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য সাবান বা লিকুইড সোপ দিয়ে হাত ধুলেই চলে। লিকুইড সোপ নিলে প্রতিবার হাত ধোয়ার সময় অন্তত ৩ মিলিলিটার নেয়া উচিত। প্রথমে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে এরপর সাবান বা লিকুইড সোপ হাতের কব্জি পর্যন্ত মাখানো উচিত। এরপর হাতের উভয়পাশে, আঙ্গুলের ফাঁকে, নখের চারপাশে ও ভেতরে অন্তত ২০ সেকেন্ড ঘষা উচিত। এরপর পানির স্রোতধারায় (জমানো পানির চেয়ে প্রবহমান পানি বেশি কার্যকর) হাত দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে ফেলা উচিত। তারপর পরিষ্কার টাওয়াল দিয়ে হাত আলতো করে মুছতে হবে। মোছার সময় ঘষামাজা না করাই ভাল, এতে ত্বকের ক্ষতি হয়। হাত ধোয়ার সচেতনতামূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। তাদের ধারণা, গরিব দেশগুলোর নিরন্ন মানুষের পক্ষে সাবান কেনাটা বিলাসিতা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম উগান্ডায় শতকরা ৯৫ ভাগ, কেনিয়ায় ৯৭ ভাগ আর পেরুতে ১০০ ভাগ মানুষের ঘরেই সাবান থাকে, তবে তারা গোসল বা থালা-বাসন মাজতেই সাবান ব্যবহার করেন, হাত ধুতে খুব একটা সাবানের ব্যবহার করেন না। আসলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া হলো সুস্থ থাকার সবচেয়ে সস্তা উপায়। আমরা সুস্থ থাকার জন্য অনেক নিয়ম মানি, অনেক কিছু খাই, চিকিৎসকের কাছে যাই। অথচ সুলভ মূল্যের একটি সাবান কিনলে আর একটু সচেতন হলে আমরা অনেক নীরোগ থাকতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়রিয়া কমাতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন, রোটা ভাইরাস ভেকসিন কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিশু ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে সরকারের যে চিকিৎসা ব্যয় হয়, তার চেয়ে অনেক অর্থ কম খরচ হবে যদি জাতীয়ভাবে হাত ধোয়ার কার্যক্রম ছড়িয়ে দেখা যায়। তাই যে কোন দেশের সরকারের জন্যই হাত ধোয়ার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা ও এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেয়াÑ একটি জরুরী, কার্যকরী ও সাশ্রয়ী প্রকল্প। তবে এটা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষের উচিত সঠিক নিয়মে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যদের সচেতন করা। হাত না ধুলে যে বিভিন্ন অসুখ হয় তাই নয়, অসুখে ভুগলে শারীরিক ভোগান্তি তো আছেই, তার সঙ্গে মানসিক কষ্ট, ক্লান্তি ভাব, স্কুল কামাই, কাজে ব্যাঘাত, ডাক্তার দেখানো, ওষুধ খাওয়া, অর্থেরও অপচয় কম হয় না। তার চেয়ে স্বল্প টাকায় একটি সাবান কিনে হাত ধোয়ার অভ্যাস করলে কী বা এমন ক্ষতি! রেজিস্ট্রার (শিশু বিভাগ), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
×