ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরদার সিরাজুল ইসলাম

পার্বত্য শান্তিচুক্তি পাহাড়ে নির্মূল হয়েছে সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২ ডিসেম্বর ২০১৫

পার্বত্য শান্তিচুক্তি পাহাড়ে নির্মূল হয়েছে সন্ত্রাস

পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ভারতের স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে নিজেদের সবকিছুই রাজা বা মোড়লদের নিজস্ব আইন-কানুনের মধ্যে চলত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। সেখানে কেবল সরকারের একজন জেলা প্রশাসক ছিলেন। বিচার আচার তাদের নিজস্ব নিয়মে, কোন কোর্টকাচারির আওতায় তারা আসেনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ২টি আসনে বিজয়ী হতে পারেননি তার একটি হলো পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায়। উল্লেখ্য, ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরও পাকিস্তানে অবস্থান নেন। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ যাতে আমাদের স্বীকৃতি না দেয় তার জন্য ত্রিদিব রায়কে জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন। বস্তুত পাকিস্তান আমলে এলাকাটি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে আসছিল যা জিয়া-এরশাদ-খালেদা অব্যাহত রেখেছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় তারা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ১৯৭৬ সাল থেকে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সি শুরু হয়। সূচনায় শান্তিবাহিনীর টার্গেট ছিল থানা আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র লুট; পুল, কালভার্ট ও সরকারী সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং বিত্তশালী লোকজন ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা। সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা না করে ১৯৭৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বাঙালী অভিবাসন শুরু করেন। সেবার প্রতিটি বাঙালী পরিবারকে ৫ একর জমি ও নগদ ৩ হাজার ৬ শত টাকা দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালীর সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখেরও বেশি। এখন সেখানে পাহাড়ীর চেয়ে বাঙালীর সংখ্যাই বেশি। শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘ ৪ দশকের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭। চুক্তি স্বাক্ষর করেন তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পার্বত্য এলাকার তিন সংসদ সদস্য, চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং অন্য নেতৃবৃন্দ। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দেশ তাদের শত্রুতা অবসানের লক্ষ্যে যখন মতভেদ ভুলতে বসেছে, তখন শান্তিকামী জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ মহল শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল যা এখনও অব্যাহত। অতীতে নিজেদের ব্যর্থতা এবং তৎকালীন সরকারের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা যে এ কাজটি করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রবল বাধা, হরতাল ইত্যাদির মধ্যেও বিজয়ের মাঝে জনগণ যথেষ্ট উৎফুল্ল হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে এই লেখকও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্প শুরু হওয়ায় পার্বত্য এলাকার আবাদি জমির প্রায় ৫৪ হাজার একর জমি পানির নিচে চলে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পার্বত্য এলাকার এক-চতুর্থাংশ মানুষ (প্রায় ১ লাখ)। যাদের পুনর্বাসন পাক সরকার করতে ব্যর্থ হয়। যে পরিবারের ৬ একর জমি ছিল তারা পেয়েছে ২ একর। ৩ হাজার পরিবারকে কোন আবাদি জমি না দিয়ে পাহাড়ী অনাবাদী জমি দেয়া হয়। পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৫৪ হাজার একর জমির, কিন্তু আবাদের জমি পাওয়া যায় মাত্র ২০ হাজার একর। ফলে ৩৪ হাজার একর জমি বিকল্প হিসাবে দেয়া যায়নি। ৩৭৩৪টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয় অনেক দূরে মারিস্যা এলাকায়। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য তৎকালীন সরকার ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা মঞ্জুর করলেও তা শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে পৌঁছেনি। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে তৎকালীন পাক সরকারের ব্যর্থতাই তাদের ক্ষোভের কারণ- যা শেষ পর্যন্ত তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য করেছে। এমনকি তারা স্বাধীনতার দাবি পর্যন্ত তুলেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে ৪টি দাবি উত্থাপন করে তার মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল যা গ্রহণযোগ্য ছিল না। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বর মাসে জেনারেল জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে যে স্মারকলিপি দেয়া হয় তাতে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন ছিল না [মে. জে. (অব) সৈয়দ ইব্রাহিম জনকণ্ঠ ১১.১২.৯৭]। কিন্তু জেনারেল জিয়া বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নমনীয়তা কাজে না লাগিয়ে অপরিকল্পিভাবে পার্বত্য এলাকায় সমতল এলাকার দুষ্টপ্রকৃতির ৩০ হাজার যা পরবর্তীতে ২ লাখ, এখন আরও বেশি জনগণকে বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়ে পার্বত্য এলাকার সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তে যে পথ গ্রহণ করেছিলেন, তাতে সঙ্কটের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। এরশাদ আমলে বিক্ষুব্ধরা প্রথমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উচ্চারণ করলেও শান্তিবাহিনী নমনীয় হতে থাকে এবং শান্তি কমিটির মানবেন্দ্র লারমা এবং সন্তু লারমার সঙ্গে ৫/৬ বার বৈঠক হয়। জেনারেল এরশাদ শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন- যার ফলে বেশ কিছু সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তাদের আকর্ষণীয় চাকরিসহ বেশকিছু সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। সমঝোতার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ’৮৯ প্রণয়ন করেন। তার ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের উপমন্ত্রীর মর্যাদা, দফতর-বাসস্থানে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা হয়। কিন্তু জেনারেল এরশাদ পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। জেনারেল এরশাদের ধারাবাহিকতায় বিগত ’৯১-০৬ সময়ের বিএনপি সরকারের আমলে কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বে (যার অন্যতম সদস্য রাশেদ খান মেনন) গঠিত কমিটি শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা শুরু করে ১৯৯২ সালে। সেখানেও স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। কর্নেল অলির নেতৃত্বে কমিটি ১৩ বার বৈঠক করেছে যার কয়েকবার হয়েছে ভারতে, ঢাকায় কোন বৈঠকে বসতে পারেনি। আর শেখ হাসিনা সরকার ঢাকায় চুক্তি করেন প্রকাশ্যে। তাদের আমলেই যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছে- যা এখনও বহাল রয়েছে। বিএনপির সেই কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেননের ১৯৯৭ সালে ভোরের কাগজে প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে এ স্বীকৃতি পাওয়া যায় যে, তারা স্বায়ত্তশাসন দিতে পর্যন্ত রাজি ছিল। কর্নেল অলি এক ধাপ এগিয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়া উচিত। শেখ হাসিনা সরকারের তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে যে কমিটি হয়েছিল তাতে বিএনপিদলীয় দু’জন সদস্য ছিল কিন্তু তাদের দল থেকে কমিটিকে সহযোগিতা প্রদানে বিরত রাখা হয়েছিল। চুক্তিতে কি আছে, তা না দেখেই বিএনপি এর বিরোধিতা শুরু করেছিল। তারা কেন চুক্তি করতে পারেনি তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে তাদের ব্যর্থতার জায়গায় শেখ হাসিনা সরকারের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল। ২ ডিসেম্বর (১৯৯৭) স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সরকার পক্ষে তৎকালীন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ নেতৃত্বে গঠিত কমিটি, যাদের মধ্যে পার্বত্য জেলার ৩ জন সদস্যই উক্ত সময়ে সরকারদলীয় সদস্য। অর্থাৎ পার্বত্য জেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা চুক্তি স্বাক্ষর করার অধিকারী। ব্যাপক অর্থে নিজ জনগোষ্ঠীর একটি অংশের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিপক্ষের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’-এর প্রতিনিধি কারা? বর্তমান সরকার যাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে তাদের সঙ্গেই এরশাদ-খালেদা সরকার চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল। সমস্যা ঝুলিয়ে রাখার চাইতে তা সমাধানই জনগণের কাম্য। যে কোন চুক্তিই একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পক্ষ-বিপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতার একটা ব্যাপার আছে। প্রয়োজন স্টেটসম্যানসুলভ পদক্ষেপ। ৬০-এর দশকে অঙ্কুরিত, ’৭৬-৯০ সময়ে বিস্তৃত এবং তুঙ্গে ওঠা সমস্যার সমাধান প্রচেষ্টা ’৮৭-৯৬ সময়কালে সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার মাত্র এক বছর চেষ্টা করে একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছেছে ২ ডিসেম্বর ’৯৭ স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তি তাদের পক্ষেই সম্ভব, যাদের আছে দেশ ও জাতির কাছে অঙ্গীকার এবং যারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এ চুক্তিতে দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটা অতীতে যারা উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের চাইতে বেশি নয়, বরং আরও অনেক কম দিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি। তারাও ক্লান্ত, কতকাল আত্মগোপনে থাকবে? শেখ হাসিনার সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে মাত্র। চুক্তিটি পাঠ না করে দাসখত, সংবিধানবিরোধী বলে যারা জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার করছে তারা জ্ঞানপাপী বৈ কিছু নয়। কেননা, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখ-তার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে (কোটেশনটি চুক্তি থেকে উদ্ধৃত) স্বাক্ষরিত চুক্তিটি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়, স্বীয় দেশের নাগরিক একটি অভিমানী সম্প্রদায়ের সঙ্গেই হয়েছে- যারা সংখ্যায় স্বল্প। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে, চুক্তিটি হয়েছে তাদের সঙ্গে। এতে সংবিধান লঙ্ঘন হয় কিভাবে? এ চুক্তি বরং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮-এ বর্ণিত ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না’ বলে যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি যে বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়েছিল তা দূরীভূত করা হয়েছে। এই চুক্তি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ‘৮৯ সংবিধানসম্মতভাবে প্রণীত এবং এতে যে সব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে হলে যে এর নাম ‘পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ’- এর পরিবর্তে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ করা যায়। একটি জেলা পরিষদকে কি ছাড় দেয়া হয়েছে বা দেয়া যেতে পারে- তা যে কোন সাধারণ মানুষই এই সরল সমীকরণ বুঝতে সক্ষম। ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’ দিয়ে যাদের খুশি করা যায়নি, তাদের জেলা পরিষদ দিয়ে চুক্তি করে শেখ হাসিনা সরকার সত্যি কৃতিত্বের দাবিদার হতে পেরেছে। জেনারেল জিয়া বিনীতা রায়কে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। উপজাতীয়দের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রী নিয়োগ এবং মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধমে বরং তাদের সম্মানিত করা হয়েছে। চুক্তিস্বাক্ষর : অতঃপর অতঃপর চুক্তি করা সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন আরও কঠিন। বাস্তবায়ন- ক. সরকার বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা। খ. শান্তিবাহিনী অস্ত্রসমর্পণ করবে- তারপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার। এ ধরনের সাধারণ জীবনযাপনের সুযোগ প্রদর্শনের নজির বাংলাদেশের অন্যত্রও আছে (সর্বহারা পার্টি)। গ. সমতল অঞ্চলে যারা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে তাদের অবস্থান অক্ষুণœ রেখে শান্তিবাহিনীর যারা অস্ত্রসমর্পণ করেছে তাদের পুনর্বাসন। শুধু শান্তিবাহিনী নয়, জনসংহতি সমিতির কার্যকলাপে জড়িত স্থায়ী বাসিন্দাদের (এতে সমতল ভূমি থেকে যারা স্থায়ী আবাস গড়েছে তারাও রয়েছে)। ঘ. ঋণ মওকুফের সুবিধা প্রদান ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। ঙ. যে জমি পানির নিচে চলে গেছে তা জেগে উঠলে তা তার মালিককে ফেরত দেয়ার ঘটনা দেশের প্রচলিত বিধান, নতুন কিছু নয়। চ.ভূমিহীন বা দুই একরের কম জমির মালিক উপজাতীয় পরিবারের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করতে পরিবারের প্রতি দুই একর জমি স্থানীয় এলাকায় জমির লভ্যতা সাপেক্ষে বন্দোবস্ত দেয়া তো এ দেশে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ছ. উপজাতীয়দের চাকরির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা নতুন কিছু নয়। ঝ. উপজাতীয় কৃষ্টি সংরক্ষণ নতুন কিছু নয়। ঞ.সেনাবাহিনী, বিডিআর আছে এবং থাকবে স্বাভাবিকভাবে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলেই স্বাভাবিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। বর্ডার পাহারা ব্যবস্থা থাকবে অন্যান্য অঞ্চলের মতো। এতে কোন পক্ষের ভয়ের কোন কারণ নেই। স্থায়ী বসতি স্থাপনকারীদের বিতাড়নের কোন চুক্তি এটি নয় বরং তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দিক সতর্কভাবে রক্ষিত হয়েছে। তবে চুক্তি করে শান্তি হয় না, যদি না উল্লিখিত এলাকার জনগণ ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সহমর্মিতা, হৃদ্যতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করেন উভয়ের স্বার্থে। পার্বত্যবাসী সহঅবস্থান মেনে নিয়েছে। তারা চায় ভালবাসা। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা কাপ্তাইয়ের বিদ্যুত পেয়েছি, আরও অনেক কিছু পেয়েছি। ভাই ভাইয়ের বিরোধ নিজেদেরই মেটাতে হবে। সরকার শুধু পারে সহযোগিতা করতে। কে বেশি পেল আর কে কম পেল সেটা বড় কথা নয়। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে তাদেরই রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। যারা অতীতে শান্তি দিতে পারেনি, তাদের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শান্তি স্থাপিত হলে পাহাড়ী পতিত জমি ব্যবহৃত হবে, খনিজ সম্পদ উন্নয়নসহ যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফল ভোগ করবে প্রথমত ঐ এলাকার জনগণ এবং সামগ্রিকভাবে দেশবাসী। তাই শান্তির কোন বিকল্প নেই। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময় বিশ্বে এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। খোদ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এ ধরনের চুক্তি তাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে করতে পারলে ধন্য হতো। এমনও কথা উঠেছিল এই কৃতিত্বের জন্য শেখ হাসিনা শান্তিতে নোবেল পাওয়ার দাবিদার হতে পারেন নিঃসন্দেহে। এই চুক্তিটি করার সময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশের এক-দশমাংশ অর্থাৎ ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। কিন্তু ভারত তো হয়নি বরং শেখ হাসিনার সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের অংশ যা প্রায় সমতল ভূমির সমপরিমাণ অংশ যোগ হয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে। আর উক্ত এলাকায় বাংলাদেশের কোর্টকাচারি ছিল না, বিচার আচার চলত পাবর্ত্য এলাকার সেই সনাতন রীতিনীতিতে। এখন সেখানে বাংলাদেশের কোর্টকাচারি স্থাপিত হয়েছে যার ফলে উন্নয়নের ছায়া এখন পার্বত্য অঞ্চলে। সমতল অঞ্চলের প্রায় সমান। তাই পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ হয়েছে। লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
×