ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শৈল্পিক ফুটবলার গাফফার

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২ ডিসেম্বর ২০১৫

শৈল্পিক ফুটবলার গাফফার

ঢাকার ফুটবলে একসময় মাঠ কাঁপিয়েছেন রথী-মহারথীরা। রঙিন সময়ের সেই সব স্বপ্নের তারকারা যেন এখন অনেকটাই অগোচরে! মাঠ কাঁপানো সেই সব সাবেক কিংবদন্তিকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন রচনা করছে দৈনিক জনকণ্ঠ। এবার পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো সাবেক তারকা ফুটবলার আবদুল গাফফারকে। সাক্ষাতকার টি ইসলাম তারিক সিনেমার জগতে তারুণ্যের প্রতীক, যার হেয়ার স্টাইল, পোশাক পরিচ্ছদ ছিল চোখে পড়ার মত। ম্যাচিং করে পোশাক পরতে যিনি ছিলেন অভ্যস্ত। সেই সময়ের তরুণরা যাকে ফ্যাশনের জগতে আইডল হিসেবে মানতো তিনি ছিলেন সবার প্রিয় চির সবুজ প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবাল। ঠিক তেমনি ফুটবলের জগতে ফুটবলকে একটা শিল্প হিসেবে মেনে নিয়ে মাঠে নিজস্ব স্টাইলে খেলা, খেলাকে উপভোগ করা যার ছিল নেশা এবং মাঠের বাইরে যিনি পুরোপুরি সৌখিন একজন মানুষ, যার পোশাক পরিচ্ছদ আজও নজরকাড়া, যিনি মাঠের ব্যাকভলি আর সাইডভলির মাস্টার হিসেবে পরিচিত, যিনি খেলার মাঠে ছিলেন ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী, চলনে বলনে যিনি খুবই সৌখিন। নিজের টাকায় গাড়ি কিনে হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে গান শোনা, আর নতুন নতুন পারফিউমের সুগন্ধ যাকে উৎফুল্ল রাখে সব সময়। তিনি আমাদের প্রিয় ফুটবলার মোঃ আবদুল গাফফার, ফুটবল সমর্থকরা যাকে জানেন এবং চিনেন গাফফার নামে। ‘যতই উঠিবে ততই পাইবে যতই ঘুমাবে ততই খোয়াবে’ বাবার এই কথাগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের ফসল বাংলাদেশের লাখো ফুটবল সমর্থকদের ভালবাসার মানুষ এই গাফফার। জন্ম ঢাকার রাজাবাজার। সেই ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ। প্রিয় মাঠ আমবাগান যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর কর্মচারীদের আবাসস্থল। আর গ্রিন ফিল্ড নামে পরিচিত যা বর্তমানে তেজগাঁও কলেজ সেখানে ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু, শামসুল আলম মঞ্জুসহ অনেক কৃতি ফুটবলারদের চলাফেরা আর ফুটবল প্র্যাকটিস দেখেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণটা আরও বেশি বেড়ে যায়। তেজগাঁয়ের ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন গাফফার। ১৯৭৫ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউট এবং ১৯৭৭ সালে শান্তিনগর ক্লাব। ওই বছরই ঢাকা মোহামেডান ক্লাব থেকে আগাখান ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলার আমন্ত্রণ পান। গুরুদেব সিং কে ফাকি দিয়ে মোসাব্বের পাওয়ার শটে এবং পেনাল্টি থেকে গোলে অল ইন্ডিয়া ফুটবল দলকে পরাজিত করার স্মৃতি আজও অম্লান। অতঃপর ১৯৭৮ সালে শামসুল আলম মঞ্জু মোহামেডানে খেলার আমন্ত্রণ জানান গাফফারকে। তিনি আর বছর দুই এক পর বড় দলে খেলার আগ্রহ প্রকাশ করেন । ১৯৭৯ সালে মোহামেডান খুব খারাপ ফলাফল করে। ১৯৮০ সালে ক্লাব অফিসিয়ালরা তখন এক ঝাক নতুন খেলোয়াড় দিয়ে দল গঠন করেন। ওই সময় মোহামেডান দলে জায়গা করে নেন ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী স্টাইলিস্ট গাফফার। গাফফারের সাইড ভলি আর ব্যাক ভলি ছিল ঢাকার মাঠে নজর কাড়া। লেফট উইং দিয়ে বল নিয়ে ড্রিবলিং করতে করতে বিপক্ষ সীমানায় বল জোগান দেয়া মাঝে মাঝে উড়ন্ত বলে সাইড কিংবা ব্যাক ভলিতে গোল করার দৃশ্য দর্শকদের আজও মনে আছে। গাফফার জানান ’৮০ সালে ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে তার করা গোলে মোহামেডানের জয় লাভ এবং প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ তার জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা। গাফফার জানান, তাদের সময় খেলোয়াড়রা ছিলেন খুবই ফ্রেন্ডলি। ’৮২ সালে সালাম-বাদল-কোহিনুর কম্বিনেশন ছিল চোখে পড়ার মত । ওই লীগে সালাম যখন বেশ কিছু গোল পেয়ে যায় তখন সবার নজর ছিল সালাহউদ্দিন ভাইয়ের ২৪ গোলের রেকর্ড ভাঙা । দল জয়ের পাশাপাশি সবার ইচ্ছা ছিল সালাম কে দিয়ে গোল করানো । এ প্রসঙ্গে গাফফাার ১৯৮২ সালে মোহামেডান-ওয়াপদার একটা ম্যাচের স্মৃতিচারণক করেন। ওয়াপদার সঙ্গে খেলা চলছে। মোহামেডান তখনও গোল পায়নি। একসময় ডিফেন্স থেকে বল নিয়ে বিপক্ষ সীমানায়। সেখানে অন্যরা গোল করা বাদ দিয়ে কোহিনুর খুজচ্ছেন সালামকে। কহিনুর সালামকে চিৎকার করে ডাকেন ওই সালাম ওইসালাম বলে। এ দৃশ্য আজকাল বিরল। ১৯৮২ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলবদল করে আবাহনীতে চলে গিয়েছিলেন গাফফার। সে সময় এই আলোচিত দলবদল নিয়ে বেশ শোরগোল হয়েছিল। সকালে পত্রিকায় খেলার পাতায় বড় হরফে লিখা ছিল ‘গাফফার আবাহনীতে’। সে দিন মোহামেডান সমর্থকরা বিশ্বাস করতে পারেননি, এমন কেন হয়েছিল? এই প্রশ্নের জবাবে গাফফার জানান, হ্যাঁ সে সময় ১৯৮৩ এর অধিনায়কের জন্য প্রথমে আমার নাম আসলেও পরে আরেক জনের নাম চলে আসে। বড় দলের অধিনায়কের স্বপ্ন কার না থাকে বলেন ? নেপালে খেলে এসে যখন পুরোপুরি বুঝতে পারলাম আমি মোহামেডানের অধিনায়কত্ব পাচ্ছি না আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি আর মোহামেডানে খেলবো না । ঠিক ওই সময়ই মঞ্জুর কাদের ভাই আর তান্না ভাই ক্রীড়া পরিষদে লাল গাড়ি থামিয়ে একজন লোক দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি আসতেই আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। আমি ওই অবস্থাতেই গাড়িতে উঠি। মঞ্জুর কাদের ভাই আমাকে আবাহনীতে খেলার অফার দেন। আমি যেহেতু মোহামেডানে না খেলার সিদ্ধান্ত নেই সে কারনে আমি আবাহনীতে খেলার সম্মতি দেই, সেখানে টাকাটা মুখ্য ছিল না। দলবদলের শেষ দিন যখন আমি স্বাক্ষর করতে যাই সে মুহূর্তটার কথা কখনোই ভুলতে পারব না। কোহিনুর আর আবুল দুজন ক্লাব থেকে উঠে আসে। আমাকে চিৎকার করে বলছিল, ‘দোস্ত তুই আমাগোরে ছাইরা জাইস না, দোস্ত তুই আমাগোরে ছাইরা জাইস না। আবুল নিজেকে সামলাতে না পেরে রীতিমতো আমাকে গালিগালাজ করছিল। এই গালিগালাজ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। এমন ভালবাসার কথা কখনোই ভুলব না । মোহামেডানে তিন বছর খেলে দুইবার চ্যাম্পিয়ন আর আবাহনীতে তিন বার খেলে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন। আবাহনীতেও আমি অধিনায়কত্ব পাইনি। এটা আমার একটা কষ্ট। আবাহনীতে আসার পর ঘটে আরেক ঘটনা । তখন আবাহনীতে চুন্নু, আনোয়ার, সালাহউদ্দিন, আশিস, খুরশিদ বাবুল, অমলেশ, এমিলি, ইউসুফ, টুটুল, পাকির আলী। আবারও পত্রিকার শিরনাম “গাফফারের যায়গা কোথায়”? চুন্নু ছিল আমার মুল প্রতিপক্ষ। এরপরও সেই চুন্নুই ক্লাবে সর্বপ্রথম আমাকে কংগ্রেলুচেট করে। আমি আমার যোগ্যতা দিয়েই মুল একাদশে যায়গা করে নেই এবং সে বার ১৩ গোল করে লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার স্থান অর্জন করি। ব্রাদার্সের আরিফ ১৪ গোল করে সেরা গোলদাতা হয়েছিলেন। গাফফার জানান, আমি জানি ১৯৮৩ সালে দলবদল করে আবাহনীতে যাওয়ার কারণে মোহামেডান সমর্থকরা আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তবে সাদাকালো সমর্থকদের আমি এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই, দীর্ঘদিন আবাহনীর খেলোয়াড় এবং ক্লাবের সঙ্গে জড়িত থাকলেও আমি মোহামেডানের গাফফার বলেই পরিচিত। যখন কেউ বলে ওই যে মোহামেডানের গাফফার তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবলের সঙ্গে এখনকার ফুটবলের পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে গাফফার বলেন, আমাদের সময় খেলার জন্য খেলা ছিল, এখন টাকার জন্য খেলা। আমাদের সময় বাফুফেতে লোকবল কম ছিল, এখন সংখায় অনেক বলতে গেলে বলা যায় কর্মসংস্থান বেড়েছে কিন্তু ফুটবলের উন্নতি নেই। আমাদের সময় মিডিয়া কম ছিল আর এখন মিডিয়ার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। আমাদের সময় র‌্যাঙ্কিং ছিল ১৩২ এখন ১৮২। আমাদের সময় খোলা মাঠে ফুটবল খেলে সালাহউদ্দিন, টিপু, এনায়েত, নান্নু, মঞ্জু, সালাম, বাদল, চুন্নু, মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদ, সাব্বির, স্বপন দাস, হেলাল, টুটুলসহ আরও অনেক খেলোয়াড়দের এখনও একনামে চেনে। আর এখন মামুনুল, এমিলি ছাড়া সমর্থকরা আর কারও নাম বলতে পারবে কিনা সন্দেহ। আজকাল জেলায় জেলায় স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাঠমুখী করার উদ্যোগ কারোর নেই। বাংলাদেশের মানুষ যে ফুটবলপাগল তা অকপটে বলেন গাফফার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্প্রতি সিলেটে অনূর্ধ্ব-১৬ এবং চিটাগাং এ শেখ কামাল টুর্নামেন্ট জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দর্শক মাঠে আসতে চায় তাদের মাঠে আনার জন্য মান সম্মত খেলোয়াড় তৈরি করা দরকার। আমাদের সময় আবাহনী-মোহামেডান খেলা হলে পরিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে এমন নজীরও আছে। আগে সমর্থকদের বিয়ে কিংবা কোন অনুষ্ঠান হলে ঢাকার মাঠের তারকা ফুটবলারদের দাওয়াত করে নিয়ে যেত। এসব ঘটনাতেই বোঝা যায়, ঢাকার ফুটবলের এবং ফুটবলারদের কদর কোথায় ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি আর একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। ২০০৪ সালে গাফফার ফ্লোরিডাতে অবস্থান করছিলেন। তার স্ত্রী একটা গ্রোসারি শপে গেছেন। নতুন দেখে উনার পরিচয় জানতে চান দোকানি। তিনি জানান তার স্বামী ফুটবলার গাফফার। দোকানি বলেন ভাবি অবশ্যই গাফফার ভাইকে আমার দোকানে নিয়ে আসবেন। পরে একদিন গাফফার দোকানে গেলে ওই দোকানি গাফফারকে জড়িয়ে ধরেন। তার হাতে পুরনো কাটা দাগ দেখিয়ে বলেন, গাফফার ভাই ১৯৮০ সালে মোহামেডান ব্রাদার্সের খেলায় আপনার গোলে ব্রাদার্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয় । আপনাকে একটু ধরার জন্য কাঁটাতারের ভিতর দিয়া হাত ঢুকিয়ে এই অবস্থা হয়েছিল। গাফফার বলেন, এমন ভালোবাসা আমাকে ফুটবল দিয়েছে। এই ভালবাসা কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পাবো না। সেই ১৯৮৫ সালে ফুটবল ছেড়েছি, ১৯ বছর পর বিদেশের মাটিতে এমন ভালবাসা। সেটা ফুটবলের জন্যই। গাফফার আফসোস করে বলেন একসময় ফুটবলের টাকা দিয়ে ক্রিকেটকে সহযোগিতা করা হয়েছে। সেই ক্রিকেট আজ আমাদের গর্ব। এক সাকিব আল হাসান আর ক্রিকেট দিয়েই সমগ্র বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনে। দেশ পরিচয়ে গলফার সিদ্দিকুরের ভুমিকাও কম নয়। অথচ ফুটবল আগের চাইতে অধঃপতনে গেছে। দেশে এ যাবত কালের সেরা খেলোয়াড় এবং ফুটবল কোচ হিসেবে কাকে এগিয়ে রাখবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গাফফার জানান, ফুটবলার হিসেবে এনায়েত ভাই। তার শূটিং ছিল দেখার মতো । আর কোচ শ্রদ্ধেয় আব্দুর রহিম ও আলী ইমাম ভাই। তারা দু’জনই খেলোয়াড় সৃষ্টি করতেন। আলী ইমাম ভাই আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে ব্যাক ভলি আর সাইড ভলি মারতে হয়। যে ব্যাক ভলি আর সাইড ভলি আমাকে পরিপূর্ণ গাফফার বানিয়েছে। আমাদের সময় আমরা প্র্যাকটিস করতাম নিয়মিত। যখন সময় পেতাম তখনি প্র্যাকটিস। প্র্যাকটিস নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে মরণ চাঁদের দই বাজি লাগতাম। গাফফার উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলনের সময় সমর্থকদের ভিড় সামলানো যেত না। এখন কেউ খবরও রাখে না। সত্যি কষ্ট লাগে। গাফফার ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ যুব ফুটবলে দলে এবং ৮১ ও ৮৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। ৮৩ সালে মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন,যা ছিল গাফফারের স্বপ্ন। ফুটবলার গাফফার বাদেও আপনার একটা পরিচয় আছে ? প্রশ্নটি শুনে তিনি হাসি দিয়ে বলেন, হ্যাঁ মেয়র হানিফ সাহেবের অনুপস্থিতিতে আমি ১৯৯৭ সালে অস্থায়ী মেয়রের দায়িত্ব পালন করি। দায়িত্ব পাওয়ার প্রথম দিনেই মাননীয় প্রধানন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ডেকে পাঠান সংসদ ভবনে। তিনি আশেপাশের এলাকা দেখিয়ে আমাকে জানান, এই জায়গার নাম খেজুর বাগান ছিল। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন সেখানে খেজুর গাছ লাগানোর। আমি ওই কথা অনুযায়ী খেজুর গাছের পাশাপাশি আর অনেক গাছ মানিক মিয়া এভিনিউসহ আশপাশের সব জায়গাতেই লাগিয়ে দেই। আজ সে স্থানগুলো দেখলে প্রান জুড়িয়ে যায়। এই কাজটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা। গাফফার দীর্ঘদিন কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। ফুটবলে আপনার কোন কষ্ট? এমন প্রশ্নের জবাবে গাফফার আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া আমার খেলোয়াড়ি জীবনের একটা বড় কষ্ট। ১৯৮২ সালে মোহামেডান-আবাহনীর খেলায় গ-গোল হলে আবাহনীর ৪ খেলোয়াড়কে জেলে যেতে হয়। যা ফুটবলের কালো অধ্যায় বলে আজও বিবেচিত। ফুটবলে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আর আছে কি না সন্দেহ। সালাহউদ্দিন ভাই, চুন্নু ভাই, হেলাল আর আনোয়ার এই চারজন জেলে গেলে আমি খুব কষ্ট পাই। আমি তাদের ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠি । এটাই ছিল আমার কাল। যে কারণে আমাকে ৮২ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ দেয়া হয়। যে কারণে আমি দিল্লী এশিয়ান গেমসে খেলতে পারিনি। ২০০৪ সালে আমি আমেরিকার ওয়াহায়ো টলিডো শহরে গেছি । ছোট সহর । একটা পার্কে সব দেশের পতাকা লাগানো আছে। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা নাই। একেতো আমার দেশের পতাকা নাই তারপর পাকিস্তানী পতাকা দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে সেখানকার মেয়রের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করি। মেয়র ছিলেন জ্যাক পড। ওই মেয়র প্রতিদিন বড় ভাইয়ের দোকানে এসে এক মগ কফি আর একটা পেপার নিয়ে যেতেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলি আমার দেশের পতাকা ওই পার্কে উড়াবার জন্য। সে ৭ দিনের মাথায় ৪ জুলাই ২০০৪ সালে সেখানে আমার দেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেয়। আমি তা দেখে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। নিজের দেশের পতাকা বিদেশের মাটিতে উড়তে দেখতে যে এত ভাল লাগে তা আমার আগে জানা ছিল না। এখন আমি যতবারই ই শহরে যাই আমার দেশের পতাকাটা আমি ওই পার্কে গিয়ে একবার দেখে আসি। এটা আমার জীবনের একটা বড় তৃপ্তি। গাফফারের বাবা মৃত: হাসিম উদ্দিন, মা রহিমা খাতুন। দীর্ঘ পরিণয়ের পর ১৭ এপ্রিল ১৯৮৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সাইমার সঙ্গে। বড় ছেলে তাহসিন আর ছোট ছেলে তানযিন। গাফফার বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করেন স্ত্রী আর দুই পুত্র নিয়ে। মা ঢাকায় থাকলেও মাঝে মাঝেই নাতি নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমেরিকায় যান । গাফফার ফুটবলের টানেই প্রায়ই দেশে আসেন। বর্তমানে লেফ শেখ জামাল ধানম-ি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। দেশের ফুটবলের স্বার্থেই অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যখন যে দল ডাকবে এগিয়ে যাবেন বলে তিনি জানান। দেশের ফুটবল একদিন জেগে উঠবে এটা তার বিশ্বাস। শাড়ি কেনার জন্য মায়ের আচলে বাঁধা ছিল ২৮ টাকা। সেই টাকা দিয়ে জীবনের প্রথম ফুটবলের বুট কেনার মুহূর্তটা আজও গাফফারের স্মৃতিতে অম্লান। ৭০ জোড়া বুটের সারি, ড্রেসিং টেবিল ভর্তি পারফিউম আর আলমারি ভর্তি ট্রাউজার সেই বুট কেনার স্মৃতিকে এতটুকুন ম্লান করতে পারেনি। যিনি ফুটবল ছেড়ে দেয়ার পরও ভাবেন দেশের ফুটবল নিয়ে, যিনি ভাবেন দেশ নিয়ে। সংসদ ভবন চত্বর যিনি করেছেন সবুজায়ন। বিদেশের মাটিতে আমেরিকার ওয়াহায়ো টলিডো শহরের পার্কে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে যিনি লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেশের সম্মান বাড়িয়েছেন বহুগুণ। তিনি আমাদের ঝাঁকড়া চুলের ব্যাক আর সাইড ভলির মাস্টার, ফুটবল সমর্থকদের কোমল হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া গাফফার।
×