ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটপাথে মানবতা!

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ ভাসমান মানুষ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ ভাসমান মানুষ

খন্দকার মাহ্্বুবুল আলম দেশের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনের পাশে, রাস্তার ফুটপাথে ভাসমান-ছিন্নমূল মানুষদের দেখা যায়। কারও কারও মাথার উপরে এক টুকরো পাতলা পলিথিনের ছাউনি। ছেঁড়া প্লাস্টিক, খড়-কুটোর সাহায্যে কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই। এর বাইরে ফুটপাথের ওপর ভাসমান মানুষেরা (নারী-পুরুষ) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পাশেও একই চিত্র। সেখানে দেখা গেল, জীর্ণবস্ত্র পরিহিতা এক মধ্যবয়সী মহিলা কিশোরীর মাথার উকুন বাছতে বাছতে বিড় বিড় করে কী জানি বলতে থাকে। পাশে কুকুর-বেড়ালের ছোটাছুটি। এ যেন নিত্যদিনের দৃশ্য। ওরাও মানুষ। তবুও দেখা যায়, শীত মৌসুমের তীব্র ঠা-ায় হিম হয়ে, কখনও বা গ্রীষ্মের আগুনঝরা তাপপ্রবাহে এবং বর্ষায় বৃষ্টির নিপতিত জলে নাকাল হয়ে ওরা দিনাতিপাত করে চলছে। ওদের এহেন মানবেতর দুরবস্থার সময়ে মানুষের মানবতা কোথায় থাকে? মানবতা তখন ওদের থেকে অনেক দূরে অর্থাৎ কাগজে-কলমে আর বক্তৃতার টেবিলে মাথা কুটে মরে। এভাবে ভাসমান মানুষের সংখ্যা দেশের সর্বত্রই দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরের ফুটপাথে, রেলওয়ে স্টেশনে এবং অন্যান্য স্থানে এসব ভাসমান মানুষদের কোন রকমে ঠাঁই নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়। যত্রতত্র তাদের অপরিকল্পিত জীবনযাপনের কারণে এসব স্থানের আশপাশে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতার দরুন পরিবেশও দূষিত হয়ে ওঠে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া ভাসমান মানুষদের অনেকে দেশের বিভিন্ন বস্তি এলাকায়ও বাস করে। ওই সব বস্তির কোথাও কোথাও দুর্ধর্ষ অপরাধীদেরও ঠাঁই হয়। চলে বিভিন্ন অপরাধ-অপকর্মও। সমাজে বাস্তুহীন অসংখ্য মানুষ। তার বিপরীতে কেউ কেউ আলিশান প্রাসাদ গড়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে চলেছেন। তারাও যেমন মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত এই ভাসমান মানুষরাও তো মানুষ। তবে এত পার্থক্য কেন? যেখানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই মৌলিক অধিকারসমূহের কথা বলা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এসব ভাসমান মানুষের বেলায় কোন একটি অধিকারের সফল বাস্তবায়ন নেই। ওদের ভোটাধিকার আছে কি-না জানি না। জানি না ওরা ন্যাশনাল আইডি কার্ডহোল্ডার কি-না। থাকলে এই মানুষদের এমন অবস্থা কেন? না থাকলে এরা কি দেশের স্বীকৃত নাগরিক নয়? ওরা আমাদের ন্যায় মানুষ হলেও সুবিধাবঞ্চিত। বিভিন্ন কারণে এসব ভাসমান মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী ভাঙ্গন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশগত বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণে মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের নানামুখী অত্যাচারের কারণে এ বিপর্যয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও এর অন্যতম কারণ বলা চলে। যেমন- কোন পরিবারে সীমিত ভূ-সম্পত্তির তুলনায় সদস্য সংখ্যা অত্যধিক হলে স্বাভাবিক কারণে একই স্থানে সবার ঠাঁই মেলে না। এ রকম হতদরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে কেউ পৈত্রিক ভিটেমাটিতে থাকলেও আর কেউ নগদ কিছু টাকার বিনিময়ে ভূমি অধিকারহারা হয়ে ভাসমান জীবনে চলে যায়। ভাসমান মানুষদের নিয়ে শিল্পী ভূপেন হাজারীকার সেই গান মনে পড়ে যায়- ‘মানুষ মানুষের জন্যে/জীবন জীবনের জন্যে/একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ শীত মৌসুম এলে কতিপয় বিত্তবান এই ভাসমান মানুষদের মাঝে কিছু শীতবস্ত্র দিয়ে নাম কুড়ানোতেই সুখ খুঁজে থাকেন, যা স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ভাসমান মানুষের জন্য প্রাথমিকভাবে ভূমি এবং গৃহ দরকার। বিত্তবানরা চাইলে তাদের পড়ে থাকা ভূমিতে ভাসমানদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকে
×