ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীদের জীবন বিপন্ন

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীদের জীবন বিপন্ন

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা ॥ বাল্যবিয়ে প্রবণতায় গাইবান্ধার বিবাহিত কিশোরীদের বিপন্ন যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য ও জীবন। সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হাজীপাড়া গ্রামের বিবাহিত কিশোরীদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। শৈশব জীবন শুরুর প্রারম্ভেই এসব বিবাহিত কিশোরী তাদের অপুষ্ট শরীরে গর্ভধারণ করেছে। এতে জন্ম নিয়েছে অপুষ্টি আক্রান্ত শিশু আর বেড়েছে মা শিশুর জীবনের ঝুঁকি। সরেজমিনে ওই এলাকা পরিদর্শনে দৃশ্যমান হয়েছে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিপন্নতা আর অধিকার বঞ্চনার এক করুণ চিত্র। রামচন্দ্রপুর হাজীপাড়া গ্রামের আল আমিন (১৮), আফরুজা (১৫) এক কিশোর-কিশোরী দম্পতি। ওদের বিয়ে হয়েছে ২ বছর আগে। যখন ওদের দু’জনার বয়স ছিল যথাক্রমে ১৬ আর ১৩ বছর। শৈশবের খেলাধুলা ছেড়ে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী আফরুজাকে ওর আপন মামাত ভাই আল আমিনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয় সংসারের জটাজালে। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর কৃষিজীবী পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হওয়ায় শুধু বৈষয়িক কারণেই লেখাপড়া শেখার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে সংসারের দায়িত্বে সম্পৃক্ত হতে হয় কিশোর আল আমিনকে। আর পিতা-মাতার ইচ্ছায় বংশ রক্ষায় এবং তাদের নাতির মুখ দেখার তাড়নায় বিয়ে করে অতি দ্রুত সন্তানেরও জন্ম দিতে হয়। যৌন জীবন এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করার আগেই বিয়ের ছয় মাসেই ১৩ বছরের কিশোরী আফরুজা গর্ভধারণ করে। যথারীতি তার গর্ভে জন্ম নেয় অপুষ্ট এক মেয়ে শিশু আম্বিয়া। শুরুতে সন্তান বুকের দুধ পেলেও অপুষ্ট শরীরে মা আফরুজার বুকের দুধের ঘাটতি দেখা দেয়ায় এই কিশোরী মা কি খাইয়ে শিশুকে প্রতিপালন করবে তাই নিয়ে পড়ে নিদারুন বিপাকে। সেই সঙ্গে সন্তান জন্ম দেয়ার পরই হাত পা জ্বালা, মাথা ঘোরা, ঘন ঘন পাতলা পায়খানাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় দুর্বিসহ ওঠে এই কিশোরী মায়ের দৈনন্দিন জীবন। নবাগত শিশুও সর্বক্ষণ কোন না কোন অসুখে ভুগে আফরুজার রাতের ঘুমও কেড়ে নেয়। এমন অবস্থাতেও সংসারের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম থেকে রেহাই মেলেনি তার। সেই সঙ্গে স্বামীর রাতের অযাচিত কষ্টকর চাহিদা পূরণ। বিয়ের দিন সেই যে বধু হয়ে শ্বশুরবাড়ি কাম মামার বাড়ি এসেছিল আফরুজা। এরপর একদিনও মা-বাবার বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারেনি সে। এর কারণ জিজ্ঞাস করতেই ছলছল চোখে আর কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানায়, ‘কেটা নাইওর নেবে মোক, মা গার্মেন্টসে কাম করে ঢাকা, বাপের বাড়িতেও সৎ মা। শুধু ফোনেই কথা কয় মা, মা’র বাড়ি তার যাওয়া হয় না। তাই এটি এই শ্বশুরবাড়িতে যে মোর জীবন আষ্টে দৃষ্টে বান্ধা।’ হাজিপাড়া গ্রামের বিবাহিত কিশোরী স্বপ্না (১৬) আর মৌসুমীরও (১৬) একই হাল। স্বপ্নার ১৩ বছর বয়সে ১৭ বছরের শ্রমজীবী আশরাফুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। আর বিয়ের সাত মাস না যেতেই গর্ভধারণ করে সে। সন্তানের বয়স এখন ২ বছর ছয় মাস। সন্তান জন্মের পর থেকে মা সন্তানের নানা শারীরিক অসুখ যেন কাটতেই চায় না। তার উপর পেট ব্যথায় আক্রান্ত সে। দাম্পত্য সুখ, প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য অধিকার সব থেকেই বঞ্চিত এই কিশোরী বধূ। শুধু সংসারের কাজকর্ম, সন্তান লালন পালন আর দায়সারা এক দাম্পত্য জীবনের এই গ্যাড়াকলের চক্রে এখন আটকানো সে। এক্ষেত্রে ওর একটাই অনুভূতি- ‘উগলা কিছুই মুই জানোম না, আর জানিবা কি হবে। মোর এটা একটা আবার জীবন হলো।’ পনের বছরের কিশোরী মৌসুমীর মনোয়ারুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল যখন তার বয়স ১৮ বছর। দাম্পত্য সুখ কি তা বোঝার আগেই বিয়ের ১ মাস না পেরুতেই গর্ভে সন্তান আসে তার। সন্তান মারুফের বয়স এখন মাত্র ১০ মাস। নানা শারীরিক সমস্যা সঙ্কট আর অসুখ বিসুখের যন্ত্রনা সয়ে, কলুর বলদের মতো সংসারের ঘানি টানাই এখন তার ভবিতব্য। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং জীবন সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। এ কথার জবাবে মৌসুমীর- ‘ক্যান যে বিয়া হলো সেটাই তো মোর এখনও বোজা হলো না। আর কি বা আছে মোর জীবনে। খালি খালি অসুখে ভোগা আর সারাটা দিন কাজ কাম আর ছইল পালা।’
×