ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাজা কমানোর আবেদন আদালতে;###;এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর- খন্দকার মাহবুব

৪৪ বছর পর এই প্রথম ॥ দোষ স্বীকার নিজামীর

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

৪৪ বছর পর এই প্রথম ॥ দোষ স্বীকার নিজামীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মানবতাবিরোধী অপরাধ স্বীকার করেছেন তার আইনজীবী। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী আপীল শুনানিতে অপরাধ স্বীকার করে সাজা কমানোর আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল। জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের একজন অভিযুক্ত নেতা যে অপরাধী সেটা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদ-ের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। আগামী ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাদের শুনানি করবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপীল বেঞ্চে বুধবার শুনানি শেষ করে আসামিপক্ষ। পরে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক শুরুর পর শুনানি মূলতবি করে পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়। এ বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে ৫ বছর ৮ মাসে মোট ২১ মামলায় ২৪ জনকে দ- প্রদান করা হয়েছে। আপীল বিভাগে ৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী ফাঁসি কার্যকরের আগে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বিচারের সময় তারা একাত্তরের ঘটনায় অনুতপ্ত হয়ে দোষ স্বীকার করেননি। এবারই প্রথম জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী যুক্তিতর্কের শেষপর্যায়ে দোষ স্বীকার করলেন। অর্থাৎ মুজাহিদ ও সাকা প্রাণভিক্ষা চাইলেন আর নিজামীর আইনজীবী দোষ স্বীকার করলেন। এ ঘটনার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে বলেছেন যে, নিজামীর অপরাধ প্রমাণ হলেও যাতে বয়স বিবেচনায় তার সাজা কমিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে নিজামী যে অপরাধ করেছেন সেটা তার আইনজীবী স্বীকার করে নিলেন।’ এদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সংবাদ সম্মেলনের পর নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেছেন, এটা বিভ্রান্তিকর ও দায়জ্ঞানহীন বক্তব্য। এমন প্রশ্নই আসে না। তিনি আরও বলেছেন, ‘তাহলে মামলা করলাম কী করে? এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের বিষয়ে আমাদের অবস্থান বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিষ্কার করব।’ আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘উনারা যে সাবমিশন করেছেন, আমি যা বুঝেছি, তাতে আমার মনে হলো- জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের অভিযুক্ত একজন নেতা যে অপরাধী, তা তারা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদ-ের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন।’ শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, বক্তব্য শেষ করার সময় উনাদের শীর্ষ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন যেটা বলেছেন- ‘এটা তো ঐতিহাসিক ঘটনা যে খুন বা মানুষ হত্যা এগুলো হয়েছে এবং এগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে সেই সময়ের জামায়াতে ইসলামী। মতিউর রহমান নিজামী তার বিশ্বাস থেকেই এগুলো সমর্থন করেছেন।’ মাহবুবে আলম বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে খন্দকার মাহবুব বলেছেন- এগুলো যদি (নিজামী) করেও থাকেন, তবু বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি দেয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি। এটা আমি যা বুঝেছি, সেটাই আপনাদের বললাম।’ বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। এদিকে আপীল শুনানি চলাকালে খন্দকার মাহবুবের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাজাকাররা সমর্থন না করলে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান থেকে এসে পাকিস্তানী সেনারা এ দেশে নয় মাস থাকতে পারত না। তারা থাকতে পারত তিন মাস। এ সময় খন্দকার মাহবুব বলার চেষ্টা করেন, নিজামীকে যে অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ইসলামী ছাত্রসংঘ নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে, বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনার পর। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় নিজামী দায়িত্বে ছিলেন না। তখন প্রধান বিচারপতি নিজামীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘একাত্তর সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল না। এরাই (নিজামীরা) সহযোগিতা করেছেন মিলিটারিদের।’ পাল্টা যুক্তি দিয়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘এখানে উল্লেখিত ঘটনার দিন ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি (নিজামী) বদর বাহিনীতে ছিলেন না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যুদ্ধের শেষে যদি এ কথা বলেন, তাহলে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে, নিজামী লিডার ছিলেন? আপনি টোকিও ট্রায়াল দেখেন।’ তখন খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘টোকিও ট্রায়াল দেখাবেন না। তাহলে পাকসেনাদের তো বিচারের আওতায় আনছেন না।’ প্রধান বিচারপতি ফের বলেন, ‘আজকে তো পাকিস্তান এটা অস্বীকার করে।’ মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে সত্য, কোন আর্মি মুভ করত না যদি পুলিশ লিড না দিত। নিজামীর মতো ইয়াংরা পথ দেখাল আর আর্মিরা সেখানে গেল- এটা ইমপসিবল।’ বুধবার প্রথমে নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী এস এম শাজাহান। পরে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন খন্দকার মাহবুব, যিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। দিনের শুনানি শেষে এ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ফৌজদারি মামলায় একজন আসামি সব সময়ই বিকল্প যুক্তি দেখাতে পারে। ফ্যাক্টের ব্যাপারে প্রথমে অস্বীকার করেও পরে তারা বলতে পারে- ‘হ্যাঁ সেগুলো করেছি ঠিকই, তারপরও আমি মৃত্যুদ- থেকে রক্ষা পেতে চাই।’ ৭২ বছর বয়সী নিজামী চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলারও মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। ২০০১-২০০৬ সালের চারদলীয় জোট সরকারের সময় তাকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও তাকে ‘মন্ত্রিত্ব উপহার দেয়াকে’ লাখো শহীদের প্রতি চপেটাঘাত বলা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় গ্রেফতারের পর ওই বছরের ২ আগস্ট নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তখন থেকেই তিনি কারাগারে। ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল করা হয়। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পেশ করে তাতে ১৬৮টি কারণ উল্লেখ্য করে দ- থেকে খালাস চেয়ে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন এ আপীলটি দাখিল করেন। ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপীল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপীলে ১৬৮টি গ্রাউন্ড পেশ করে দ- থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আর প্রমাণিত চারটি অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। অন্য চারটি অর্থাৎ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মাহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র (৩ নম্বর অভিযোগ), বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ৫ ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। এগুলোও ছিল হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উস্কানি ও প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ।
×