ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার আহ্বান

দেশের এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

দেশের এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী

নিখিল মানখিন ॥ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী। আর বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে ৫২ ভাগ পুরুষ ও ৪৮ ভাগ নারী। আর শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ৪০ লাখ, মানসিক প্রতিবন্ধী ৩৮ লাখ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ৩৩ লাখ। এছাড়া বাক, শ্রবণ ও নানা ধরনের মিলে মোট ২৫ লাখ প্রতিবন্ধী রয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ জরিপে দাবি করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের পরিসংখ্যান তৈরির জন্য ‘প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ’ কার্যক্রম চালাচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারের এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় ‘প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩’ বাস্তবায়ন করছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রায় সব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীতে এমনকি সরকারী-বেসরকারী উভয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে অবহেলা ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়। তাদের প্রতি অসম দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে এখনও সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। অনেক পরিবারে তাদের দেখা হচ্ছে বোঝা হিসেবে। বোঝা হিসেবে না দেখে প্রতিবন্ধীদের জনসম্পদে রূপ দিতে হবে। আর সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে এখনও দেশের মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের শিশুদের ব্যবহারের কারণে পাগল বলা হয়। এমনকি ভুল চিকিৎসা করে অনেক শিশুকে অকালে মেরে ফেলা হয়। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুরা বিশেষ কোন ক্ষেত্রে খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাই এদের প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত না করে বিশেষ শিশু বলা উচিত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩ নামে দুটি আইন পাস করা হয়েছে। কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ করলে এবং প্রকাশনা ও গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করলে তা দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া কোন ব্যক্তি অসত্য ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিবন্ধিত হলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানাযোগ্য অপরাধে দ-িত হবেন। আর কোন ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয়পত্র তৈরি করলে তার সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের মুল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য ১৯৯৯ সালে আমরা জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এ ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ ফাউন্ডেশনকে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’-এ রূপান্তর করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি করে প্রতিবন্ধী কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে ইশারা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অটিস্টিক শিশুর মায়েদের জন্য প্রাত্যহিক লালন-পালনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রবণ, বুদ্ধি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়কে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রাখা হয়েছে। দেশের ৫৫টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকেন। বিশেষ করে তাদের অবর্তমানে এই শিশুরা তাদের সম্পদের ব্যবস্থাপনা কিভাবে করবে তা নিয়ে চিন্তা করেন। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অটিস্টিক ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ এর মাধ্যমে ট্রাস্ট পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা তাদের অর্থ-সম্পদ নিরাপদে ব্যবহার করতে পারবে। সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। এজন্য গত অর্থবছর থেকে সরকার সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ বছরের মধ্যে অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান সম্পন্ন হবে। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে। বিশেষ সুবিধা হিসেবে তাদের কিছু ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করা হয়েছে। উন্নয়নের সুষম বণ্টন এবং তা সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে না দেয়া গেলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারার বাইরে রেখে সুষম উন্নয়ন হবে না। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয়ে সরকারী ও বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পেশ করে। এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীসেবা, সাহায্য কেন্দ্র কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় দেশের সকল জেলায় ৭৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, হিয়ারিং টেস্ট, ভিজ্যুয়াল টেস্ট, কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধীর কল্যাণে ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯’ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের ৫৫টি বেসরকারি প্রতবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০ ভাগ বেতন-ভাতা সরকারীভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে। সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়নের ফলে প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোতে সার্বিক কর্মকা-ে আগের তুলনায় অনেক বেশি গতি সঞ্চার হয়েছে। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয় তা পর্যাপ্ত নয়। বাজেটের মোট অর্থ থেকে মাত্র ০.১০ শতাংশ রাখা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানায় বিভিন্ন সংগঠন। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাদের জন্য উপযুক্ত ধারায় তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। চলতে-ফিরতে তাদের উপযুক্ত করে যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি। নামমাত্র যাত্রীবাহী বাসের প্রথম ১০টি আসন বরাদ্দ করা হয়েছে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। তাও কার্যকর হয় না। দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক বা সম্মিলিতি কোন চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা মানসিক বিকাশেও বাধা পায়। একটি পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী থাকলেই পরিবারের কাছে সে বোঝা হয়। তবে সে যদি পুরুষ হয় তাহলে কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে আলাদা। পরিবারের ব্যক্তিদের দ্বারা আহত হয়েও নারীকে শুনতে হয় তার কর্মদোষের কথা। দেশে অনেক নারীকে পরিবারের অত্যাচারে প্রতিবন্ধী হয়ে সংসার ছাড়তে হয়েছে। এসব নারীর আশ্রয়, কাজ ও পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। সাভার সিআরপি পক্ষাঘাত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের উপযুক্ত চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধীর অবস্থা অনুসারে তাদের জন্য হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। সেই চেয়ারে বসে বা চড়ে একজন প্রতিবন্ধী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের কাজে দক্ষ করে তোলে এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিরাটসংখ্যক প্রতিবন্ধী থাকা সত্ত্বেও এখনও প্রতিবন্ধীদের উপযোগী প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো পর্যাপ্ত হারে গড়ে ওঠেনি। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা, বিনোদন ও কাজকর্মের তেমন কোন উন্নতির দিকে কেউ এগিয়ে আসছে না। একদিকে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিজেদের জন্য বরাদ্দ কোটায় চাকরি পায় না যোগ্য প্রতিবন্ধীরা।
×