ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলি সুলতানা

ধীর তুমি ধীমতি ধারা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

ধীর তুমি ধীমতি ধারা

ইদানীং নারী শব্দের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধ্যানধারণা কাজ করছে। আমি নিজেকে নারী নয় ... একজন মানুষ ভাবতে পছন্দ করি। নারী পুরুষ শব্দ নির্দিষ্ট ফ্রেমে বাঁধা। তারপরও সৌন্দর্য পিপাসু মন সবকিছুর অগোচরে নিজেকে নারী ভাবতে বাধ্য করে। আমি নারী আমি প্রেমিকা আমি স্ত্রী আমি মা আমি বোন। নারীর এই পরিচয় সর্বজনীন। আমি শাড়ি পরি, হাতে চুড়ি কানে দুল কপালে টিপ ঠোঁটে লিপস্টিক চোখে কাজল পায়ে মল। এই সৌন্দর্যগুলো কেবল নারীর দ্বারা সৃষ্টি করাই সম্ভব। নারী হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের মূল অলঙ্কার। সাহিত্যের সব ভাষায় নারী নিয়ে হাজার হাজার কাব্য উপন্যাস রচিত হয়েছে। কিন্তু সেই নারীর ওপর নির্যাতন একটুও কমছে না। তাদের ওপর যৌন হয়রানির দাবানল খুব আক্রোশ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। নারীর ওপর যৌন হয়রানির এই জঘন্য ঐতিহ্য বহুকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত। আগে অভিভাবকরা তাদের ধর্ষিতা মেয়ের ঘটনা ধামাচাপা দিতে বাধ্য থাকত। সামাজিকতা ও মান সম্মানের কথা ভেবে। তবে এর মধ্যে ক্ষীণ আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। এখন অনেকটা সচেতন হয়ে উঠেছে ধর্ষিতার পরিবার। তাদের ঘুরে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে মাইক্রোবাসে ধর্ষিতা গারো তরুণীর পরিবার বেশ সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদে নেমে পড়েছে। এভাবে যদি প্রত্যেক ভিকটিমের পরিবার পরিজন রেপিস্টদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন, আমি মনে করি অপরাধীরা কিছুটা হলেও পিছু হটবে। এই জন্য সবচেয়ে জরুরী আইনের সঠিক প্রয়োগ। গারো তরুণীর ধর্ষক তুষার ও জাহিদকে যদি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া যায়, আমাদের দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ অবশ্যই কমবে। নরপশুরা নারকীয় উল্লাসে মেতে ওঠার আগে দশবার চিন্তা করবে। দেশে এমন একটা কঠিন আইন হওয়া উচিত। আরও একটি যন্ত্রণার দিক হচ্ছে, আমাদের সমাজ ধর্ষকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু কোন ধর্ষিতা মেয়েকে ঘরের বউ বানাতে তারা নারাজ। এই সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তবে নারী নির্যাতনের মাত্রা এখানেই থেমে নেই। আজকের যুগ অত্যাধুনিক। তাই এই অত্যাধুনিক যুগেও নারীকে সামাজিক পারিবারিকভাবে হেয় করার সুপরিকল্পিত চিন্তার বীজ বপন করা হচ্ছে। পারিবারিক গণ্ডিতে তো খুব জঘন্যভাবে নারীকে কোণঠাসা করার রেওয়াজ চালু হয়েই আছে। বিবাহিত জীবনে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য দেয়া হয় না। এখানে সে চার দেয়ালের ভেতর বন্দী। কিন্তু সামাজিকতার সিল ছাপ্পর দিয়ে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সমাজ আজ পর্যন্ত নারীকে বুক খুলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বাধা দিয়ে চলেছে। তার ইচ্ছের মূল্যায়ন আবার কি? তার কাজই হলো সন্তান উৎপাদন করা, সংসারের ঘানি টানা আর স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য ‘বান্দা হাজির’ হয়ে থাকা। এমন অসংখ্য নারী চার দেয়ালের ভেতর দম ঘুটে মরছে, চুপচাপ। তারা নীরবে অত্যাচার সয়ে যাচ্ছে। সামাজিকতার ভয়ে পারিবারিক মানসম্মানের ভয়ে বোবা হয়ে আছে। তাদের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। কারণ পিছুটান তাদের সামনের দিকে পা ফেলতে দিচ্ছে না। তারা পারছে না সাহস করে সত্য কথা বলতে। আজও স্বামীর হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয় আমাদের নারীরা। শ্বশুরবাড়ির লোকদের দ্বারাও নির্যাতিত হচ্ছে। তারা চুপ করে ভয়াবহ অত্যাচার সয়ে যাবে কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে, সন্তানদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। বাইরে অনেকেই বুঝতে দিচ্ছে না তাদের কষ্ট, দুঃখ। সুখে আছি সুখে আছি— ভাব করে ফেইক হাসি দিয়ে জীবন পাড়ি দিয়ে চলেছে। মুখের হাসির আড়ালে সযতনে লুকিয়ে রেখেছে বুকের চাপা কষ্ট। আসলে হয়েছে কি, আমরা বাইরে থেকে যা দেখি তা সত্যি নয়। বরং যা দেখি না তা-ই সত্যি। মেঘের কোলের রোদের মতো আড়ালে লুকায় নারীর অব্যক্ত যন্ত্রণা। সবাই কেন ভুলে যায়, এই পৃথিবীটাকে সুন্দর করে রেখেছে নারী ! কেন নারী তার প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছে না? নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়ার বিচ্ছিরি কৃপণতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না আমাদের সমাজ। উন্নত হতে পারেনি সমাজের অবকাঠামো। এর জন্য কিছুটা হলেও নারীর অজ্ঞতা, উদাসীনতা দায়ী। সময় এসেছে নারীর নিজের মজবুত অবস্থানের জন্য তার নিজেকে নড়েচড়ে বসতে হবে। অধিকার আদায়ের পথ নারীর নিজেকেই বের করে নিতে হবে। এর জন্য দরকার প্রত্যয়। প্রতিজ্ঞা। সাহস। সাহস না থাকলে কিছু হবে না। নারী তার প্রাপ্য সম্মান আত্মমর্যাদা নিয়ে গৌরবের সঙ্গে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেবে এবং জয়ী হবেই বলে আমি বিশ্বাস করি। সমাজের অন্ধকার খুপরিগুলোতে আলো জ্বালানোর উদ্যোগ নিতে হবে। হাত পা গুটিয়ে আর বসে থাকার সময় নেই। সমাজের নতুন সংস্করণে ভূমিকা নিতে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে। নারী এমন এক বীজ, যে বীজ থেকে উদ্ভাসিত হয় বৃক্ষ পত্রপল্লব ও পুষ্প ফল। নারী বিধাতার সৃষ্টি পৃথিবীর এক নিগুঢ় অভিজ্ঞান। নারী হলো শিল্পের উন্মেষপর্ব থেকে উৎসারণ, বিকাশকাল। শিরীস ছায়ায় শিশিরে হারায় কত ভোর। আবার প্রস্তুতি নিয়ে গোধূলি ছুঁয়েছে। তবু যে সবুর, নীলদ্যুতি অপরূপ তিলবিন্দু অনিঃশেষ কল্পনার দায় শ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িয়ে থাকে বিধাতার আপন হাতে তৈরি নারী নামক অপূর্ব ভাস্কর্য। স্মৃতি জানে নিভৃত জানালায় উঁকি দিতে। হাওয়ায় স্তব্ধ করতালি শব্দের ভিতরে বাজে। জলকে জাগায় ধীরে ধীরে। তমসা তীরে একাকী জলের খেলা। জলের ভেলায় ভেসেছে ডুবেছে বেহুলা সুন্দরী। ধীর তুমি ধীমতী ধারা, সন্ধ্যে হলে তারা রাজি। গন্ধরাজ ফুটেছে আবার। নির্বাপিত আঁধারে অখণ্ড মণ্ডলাকার এঁকে বসেছে। কাঁসার বাসনে কৌটা হচ্ছে চার পাপড়িওয়ালা ফুল। মুখচন্দ্র জগন্ময়ী টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে বোধগম্যহীন শস্যক্ষেত। সুজনি তোলো শতরঞ্জি বাঁধো। মুক্তধারা নিয়ে কল্পনা করলে এমন কটা লাইন মনের পর্দায় মুচকি হেসে ওঠে। যেন কমলতার পাশে শালুকের বন। এইসব উপমা কেবল নারীকে নিয়ে। জগতের সর্বত্র জাগরিত হোক কেবল নারী আর নারী নামের জয়ধ্বনি।
×