ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও;###;অনুবাদ : শামসুজ্জামান হীরা

খরার হারিয়ে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

খরার হারিয়ে যাওয়া

অনেক দেরিতে হলেও আমিও বিশ্বাস করলাম, সে পাগলি ছিল। এটা স্বাভাবিক। কেননা আমার মা বলেছিলেন, সে পাগলি এবং গ্রামের সবারই মনে হয় একই ধরনের অভিমত ছিল। এমন নয় যে, বুড়িটি কখনও সত্যি এমন অস্বাভাবিক কিছু করত যা পাগলেরা করে থাকে। কখনও সে বেশি কথা বলত না। কিন্তু কখনও কখনও বোধগম্য কোন কারণ ছাড়াই সে প্রবল আবেগের চাপে অনিয়ন্ত্রিত অট্টহাসির শিকার হতো। লোকজনের দিকে সে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাত, যেন তাদের দৃশ্যমান অস্তিত্বের বাইরেও কিছু দেখতে পেত- সে কারণেও হতে পারে তার সম্পর্কে লোকদের এমন ধারণা জন্মেছিল। কোঁচকানো ত্বক ও অস্থিচর্মসার দেহের সঙ্গে তার জীবন্ত জ্বলজ্বলে চোখজোড়া খাপ খেত না একদম। কিন্তু তার চোখে এমন কিছু একটা ছিল যা কোন না কোনভাবে রহস্যময়তা ও অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দিত এবং যা একেবারে শুরু থেকেই তার পাগলামি সম্পর্কে আমার বিশ্বাসে নাড়া দিয়েছিল। সেই এমন একটা কিছু কী ছিল, আর কোথায় ছিল সেটা? হতে পারে সেটা ছিল তার মধ্যেই অথবা যেভাবে সে লোকদের দিকে তাকায় তাতে বা নিজেকে বয়ে বেড়ানোর নেহাত তার অভিব্যক্তির মধ্যে। হতে পারে এটা ছিল যে কোনটার মধ্যে অথবা একই সঙ্গে সবগুলোর মধ্যে। এই স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আমার ভাবনা নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলতেন, ‘মনে হয় এটা বিষাদ। এই জ্বলন্ত সূর্য, নির্দয় খরা... ছুটে বেড়াচ্ছে আমাদের মাথার ভেতর, আমাদের রূপান্তরিত করছে সাদায় এবং পাগলে!’ আমি তখন বুঝিনি, কেন তিনি এ রকম বলতেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি, তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন না, বরং তাঁর ধারণাই উঁচু স্বরে ব্যক্ত করছিলেন। কিন্তু তিনি সঠিক ছিলেন, আমি বোঝাতে চাইছি, ‘সাদা’ সম্পর্কে সঠিক। কারণ পুরো দেশটাকেই সাদা মনে হচ্ছিলÑ মৃত্যুর মতো সাদাটে। পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়ায় সুবিন্যস্ত চোখজুড়ানো ছোট ছোট *শামবাগুলো [*শস্যক্ষেত্র] হয়ে পড়েছিল বিরান। ভূমি উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট, আমাদের জেলার কৃষকদের গর্ব এক সময়কার খাটো লতাগুল্মের দৃষ্টিনন্দন বেষ্টনীগুলো শুকিয়ে কী হতচ্ছিরি, ধুলোবালি মাখা। এমনকি আমাদের গ্রামের ঠিক নিচটাতে যে মুগুমো গাছ, কখনও যা শুকাতো না, প্রাণবন্ত শ্যামলশোভা নিয়ে যে টিটকারি দিত স্বল্পমেয়াদী খরাকে, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তারও পত্র-পল্লব। অনেকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করল। আবহাওয়াবিশারদ ও ওঝা-কবিরাজ যাদের কেউ কেউ তখনও ক্ষীণ প্রভাব নিয়ে আমাদের গ্রামে টিকেছিল, গ্রামবাসীরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসল, সবাই মহাবিপর্যয়ের পূর্বাভাষ দিল। এদিকে রেডিওর রমরমা অবস্থা। ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাষ’ যা এক সময় কেবল সম্ভাব্য ভ্রমণকারীদের আগ্রহের খবর ছিল, এখন সবারই হয়ে দাঁড়াল প্রধানতম আগ্রহের খবর। হ্যাঁ। মনে হয় *কেবিএসের [*কেনিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস] ও আবহাওয়া দফতরের লোকেরা আবহাওয়াবার্তা জানানোর জন্য তাদের ম্যাজিক যন্ত্র দিয়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে চলেছিল। কিন্তু আমাদের গ্রামের সাধারণ নারী-পুরুষরা কেবল মেঘ দেখছিল এবং অপেক্ষা করছিল। আমার বাবার চার স্ত্রী ও গ্রামের অন্যান্য স্ত্রীলোককে প্রতিদিনই শামবার দিকে যেতে দেখতাম। তারা বসে বসে গল্পগুজব করত আর আসলে অপেক্ষা করত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন ঈশ্বর বৃষ্টি দেবেন। আমাদের নতুন গ্রামের ধুলোভরা পথে যেসব বাচ্চা ছেলেপুলে এক সময় খেলাধুলা করত, বন্ধ করে দিয়েছিল তা। সবাই অপেক্ষা করছিল, আকাশের পানে তাকাচ্ছিল চাতকের ন্যায় এবং আশায় বুক বেঁধে। বহু লোক ভুখা। অন্যান্য পরিবারের তুলনায় আমরা ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার ভাইদের মধ্যে একজন নাইরোবী ও অন্যজন লিমুরুতে কাজ করত। বৃদ্ধা নারী সম্পর্কে বাবার সেই মন্তব্যটি আমাকে আরও গভীর চিন্তায় ফেলল। মাসের শেষে মা যখন বাজার থেকে কিছু শাক-লতা ও জাহি শিম কিনে আনলেন আমি সেখান থেকে কিছু আনাজ চুরি করলাম এবং সন্ধ্যাবেলায় বুড়ির মাটির ঘরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। পেয়ে গেলাম সহজেই। গ্রামের কেন্দ্রস্থলেই ছিল বুড়ির কুঁড়েঘরটা। ওটাই ছিল স্ত্রীলোকটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত। তারপর আমি সেখানে অনেকবার গিয়েছি, তবুও সেই সন্ধ্যা এখনও আমার স্মৃতিতে সবথেকে বেশি উজ্জ্বল। যখন প্রায় নিভে আসা জ্বালানি কাঠের অঙ্গার ফায়ারপ্লেসে সামান্যই দপদপ করছিল, ভুতুড়ে ছায়া ফেলছিল মাটির দেয়ালে, আমি তাকে জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম ঘরের অন্ধকার এক কোনায়। আতঙ্কিত আমি পালাতে উদ্যত হলাম। কিন্তু পারলাম না। আমি তাকে ‘দাদিমা’ বলে ডাকলামÑ যদিও মনে হলো ওই সম্বোধন পাওয়ার মতো অত বৃদ্ধা সে নয়- তাকে আনাজগুলো দিলাম। সে ওগুলোর দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে। তার চোখজোড়া কিছুটা উজ্জ্বল হলো। তখন সে তার মুখ নিচু করল এবং বিলাপ করতে লাগল। ‘আমি ভাবলাম এটা “সে”, ফিরে এসেছে আমার কাছে’, ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল এবং তারপর, ‘আহ্, খরা আমার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে!’ আমি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলাম না, দ্রুত ছুটে বেরিয়ে এলাম এ কথা ভাবতে ভাবতে যে, আমার বাবা এসব কিছু জানেন কি-না। বোধ হয় সে পাগলিই ছিল। এক সপ্তাহ পর সে আমাকে ‘তার’ সম্পর্কে বলল। যখন সে খরার বিরুদ্ধে তার জীবনব্যাপী লড়াইয়ের কথা অসংলগ্নভাবে আমায় বলল, আঁধারঢাকা সেই কুঁড়েঘরে যে বিষণœ পরিবেশ তৈরি হলো তা বর্ণনা করা শব্দের সাধ্যের বাইরে। আমি যেমন বলেছি, আমরা সবাই মাসের পর মাস বৃষ্টির অপেক্ষায় বসেছিলাম এবং তাকিয়েছিলাম। গত রাতে যখন প্রথম ক’ফোঁটা বৃষ্টি হলো তা অস্বাভাবিক এক নিঃসঙ্গতা ও অবসাদে সবার মন ছেয়ে ফেলল। রাস্তায় কোন সাড়াশব্দ ছিল না। একমাত্র সন্তানের পাশে বসে তাকিয়ে থাকা স্ত্রীলোকটি কিছু শুনল না। সে শুধু তেপায়া গিকু টুলের ওপর বসে ফায়ারপ্লেসের ধারে ছোট্ট বিছানায় তার কালো চেহারার সন্তানের তীব্র যন্ত্রণায় মোচড়ানো দেখল। যখন প্রায় শেষ হয়ে আসা আগুন থেকে থেকে দপদপ করছিল, এটা উন্মোচিত করল একটা কালো চেহারা, যা এখন সাদায় রূপান্তরিত। ভুতুড়ে ছায়া দেয়ালের এমাথা-ওমাথা ছোটাছুটি করছিল যেন একাকী বসে থাকা দর্শককে উপহাস করতে। আর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেই চলল : ‘তুমি কি মনে কর, আমি মারা যাব, মা?’ বুড়ি জানত না কী বলবে বা করবে। সে শুধু আশা করতে পারত এবং করতে পারত প্রার্থনা। তবুও ক্ষুধার্ত ছেলেটা অনুনয়ভরা কণ্ঠে বলেই চলল, ‘মা, আমি মরতে চাই না।’ কিন্তু মা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। উপলব্ধি করল, যেন তার মনোবল এবং শারীরিক শক্তি তাকে ত্যাগ করে গেছে। আবার অনুযোগের আকুতি, ‘মা, আমাকে কিছু একটা খেতে দাও।’ নিশ্চয়ই সে জানত না, জানতে পারেনি, স্ত্রীলোকটির কিছুই ছিল না, তার শেষ দানা গমটুকুও শেষ করে ফেলেছিল। সে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তার প্রতিবেশীদের আর বিরক্ত করবে না, কেননা তারা তাকে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত তারাও তাদের সহায়-সম্বল খরচ করে ফেলেছিল। তথাপিও ছেলেটি ক্ষোভ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন সে তাকে দয়ামায়াহীন একজন মানুষ হিসেবে অভিযুক্ত করছে। নিজের পুরুষ ছাড়া একজন নারী কী-ই বা করতে পারত? জরুরী অবস্থার সময় সে তাকে হারিয়েছিল, *মাউ মাউ’দের [*গধঁ গধঁ, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইরত কেনিয়ার জাতীয়তাবাদী শক্তি] দ্বারা বা ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে সে নিহত হয়নি, এক বিয়ার পানের আসরে তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এটা এতই আকস্মিক মৃত্যু ছিল যে, পারতপক্ষে লোকে কেবল এটুকুই বলত। ছেলেটাকে দেখার কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য লোকটা এখন সেখানে নেই। তার কাছে ১৯৬১’র এই রাত ’৪০-এর অপর এক রাত থেকে এতটাই ভিন্ন ছিল যে, যখন তার দুই ছেলে খরা এবং অনাহারে একজনের পর আরেকজন মারা গিয়েছিল। সেটা ছিল যাকে বলা হয় ‘কাসাভা দুর্ভিক্ষ’র সময়। লোকে কাসাভা থেকে আটা তৈরি করে খেত বলে ওটাকে এ নামে ডাকা হতো। তখন তার স্বামী তার সঙ্গে ছিল শোক ভাগ করে নেয়ার জন্য। এখন সে একাকী। তার কাছে ব্যাপারটা খুবই অন্যায্য বলে মনে হলো। এটা কি ছিল পরিবারের ওপর কোন অভিশাপ? সে এমনটাই ভাবল, কেননা তার নিজেরই জন্ম হতো না যদি না এমনই এক দুর্ভিক্ষ থেকে সৌভাগ্যক্রমে তার মাকে মিশনারিরা রক্ষা করত। এটা ঘটেছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রকৃত অর্থে কেনিয়া আগমনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। রুরায়া দুর্ভিক্ষ (ইংল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ) ছিল গিকু জনগোষ্ঠীর মোকাবেলা করা তখন পর্যন্ত সবথেকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তার দাদা-দাদি মারা গিয়েছিল, পরিবারের মধ্যে একা সে-ই প্রাণে বেঁচেছিল। হ্যাঁ। যখন সে ছেলেটার অভিযোগের, অনুনয়ের মুখ দেখে তখন সব দুর্ভিক্ষের ভয়াল চিত্র তার মধ্যে জেগে ওঠে। কেন এটা শুধু তার জন্য? কেন অন্য নারীদের জন্য নয়? এটা তার একমাত্র সন্তান, শেষ বয়সের সন্তান। সে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল এবং গ্রামের প্রধানের কাছে গেল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো, তার কাছে কিছু ছিল না। তাছাড়া মনে হলো, সে তাকে বুঝতে পারছিল না অথবা পারছিল না বুঝতে যে খরা প্রকৃতই মানুষ মারতে পারে। সে ভাবল, তার ছেলেটি সেই পুরনো রোগে ভুগছে, যা তাকে প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে। অবশ্য মা-ও এ রকমই কিছুটা চিন্তা করেছিল। ছেলেটা তার সব সময়ই রোগে ভোগা এক সন্তান। কিন্তু সে কখনও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। এমনকি এখনও সে নেবে না। না, না, এমনকি হাসপাতালও তাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তার সাধ্যমতো এই পঙ্গুর জন্য যা কিছু করা সম্ভব সেটা করাকে সে প্রাধান্য দিল এবং এবার সে বুঝল, এটা উপোস যা তাকে মেরে ফেলছিল। গ্রামপ্রধান জানাল, জেলা কর্মকর্তা খাদ্যদ্রব্যে রেশন প্রথা চালু করেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যক্রম’-এর অংশবিশেষ খরাকবলিত এলাকার জন্য। এটা সম্পর্কে সে আগে কেন শোনেনি? সে রাতে সে ঘুমাল, কিন্তু খুব ভালভাবে নয়, কেননা পঙ্গুটি জিজ্ঞাসা করেই চলেছিল, ‘আমি কি সুস্থ হব, মা?’ জেলা কর্মকর্তার কার্যালয়ে লম্বা লাইন। সে তার রেশন নিল এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্লথ পায়ে বাড়ি ফিরে চলল। সে ঘরে প্রবেশ করল না, বাইরেই বসে পড়ল, তার হাঁটুর শক্তি লোপ পেয়েছিল এবং অপরিচিত নারী-পুরুষরা তাকে কিছু না বলেই তার ঘর থেকে দলবেঁধে বেরিয়ে আসছিল। তার প্রয়োজনও ছিল না। সে জানল, তার ছেলে চলে গেছে এবং আর কখনও সে ফিরে আসবে না। বৃদ্ধা একবারও আমার দিকে তাকায়নি যখন এসব বলছিল। এখন সে চোখ তুলে তাকাল এবং বলে চলল, ‘আমি এখন একজন বুড়ি। সূর্য অস্তমিত হয়েছে আমার একমাত্র সন্তানের ওপর; খরা তাকে নিয়ে গেছে। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।’ সে আবার চোখ নামাল এবং নিভে আসা আগুন খোঁচাল। যাওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়ালাম। যদিও সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আমাকে কাহিনীটি বলেছিল, কিন্তু তা এমন ভাষায় যা অবশ্যই কোন পাগল নারীর হতে পারে না এবং সেই রাতে (সেটা ছিল রবি বা শনিবার) আমি এই বিস্ময় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, কেন কিছু লোক জন্ম নেয় যন্ত্রণা ভোগের জন্য এবং সহ্য করার জন্য অসহনীয় দুর্দশা। দুই বা তিন সপ্তাহ আগে আমি বৃদ্ধার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলি। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য আমি ভালভাবে মনে করতে পারছি না। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বলা চলে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, যদিও হালকা বৃষ্টি। স্ত্রীলোকেরা শস্য রোপণে ব্যস্ত। সবার মনে আশা জেগে উঠেছে। মূলত মুষলধারায় মৌসুমী বৃষ্টির শুরু গতকাল থেকে। একটু আগেভাগেই শুরু। এমন বৃষ্টির দেখা বহু বছর মেলেনি। আমি বৃদ্ধা নারীটির কুঁড়েঘরে উপহারসামগ্রী নিয়ে গেলাম। এবার শাক-লতা বা সিম নয়, মিষ্টি আলু। দরজা খুলে তাকে যথারীতি এক কোনায় জড়োসড়ো অবস্থায় দেখতে পেলাম। আগুন নিভে গিয়েছিল। শুধুমাত্র লণ্ঠনের কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো তখনও জ্বলে চলেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। সে সামান্য মাথা তুলল। প্রায় ক্ষয়ে আসা শীতল আলোতে তাকে সাদা দেখাল। সে তার চোখ সামান্য খুলল। সেগুলোর অস্বাভাবিক অলৌকিক উজ্জ্বলতা সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কেবল বাড়তি কিছু তাতে ছিল। দুঃখ নয়। আনন্দ বা উল্লাসের এক চিহ্ন ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কিছু একটা সে ফিরে পেয়েছে। বহুদিনের আকাক্সিক্ষত। সে হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাসিতে এমন কিছু ছিল যা অপার্থিব, প্রায় দানবীয়- কুৎসিৎ। সে কথা বলতে লাগল, দুর্বল সুরে, আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সন্তুষ্টি বা স্বস্তিকে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে। ‘আমি তাদের সবাইকে এখন দেখছি। সবাই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এবং আমি যাচ্ছি...।’ তারপর আবার সে কুঁজো হলো। তক্ষুণি কষ্টে জ্বলতে থাকা লণ্ঠনটা দপ করে নিভে গেল, কিন্তু তার আগে নয় যখন আমি দেখেছিলাম আমার দেয়া সব উপহার ঘরের কোনায় জমা করা, যা কখনও স্পর্শই করা হয়নি। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাস্তার পাশের খোলা দরজাগুলোয় আমি দেখতে পেলাম জ্বালানো আগুনের দপদপানি, শুনলাম লোকজনের চেঁচামেচি ও অট্টহাসি। বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। আমার বাবাও ছিলেন। মা এরই মধ্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করেছেন। বৃষ্টি এবং খরা যা এখন আর নেই, সেগুলো নিয়ে আমার ভাই-বোনরা বকবক করে চলল। বাবা ছিলেন যথারীতি নীরব এবং চিন্তামগ্ন। আমিও ছিলাম চুপচাপ। আমি কথাবার্তায় যোগ দিলাম না, কেননা আমার মন তখনও সেই ‘পাগলি’ স্ত্রীলোক এবং উপহার হিসেবে আমার দেয়া খাদ্য, যা স্পর্শ করা হয়নি তাতে পড়েছিল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল, সে-ও কি হারিয়ে গেছে খরায় এবং অনাহারে! ঠিক তখন ভাইদের মধ্যে একজন স্ত্রীলোকটিকে উল্লেখ করে কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করল। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তীক্ষè দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। ‘সত্যি পাগলি!’ আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম এবং সবাই সচকিত ভয় নিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের সবাই, শুধু বাবা বাদে, যিনি ফাঁকা দৃষ্টিতে একই দিকে তাকিয়েই থাকলেন। ফুটনোট : প্রথম বন্ধনীর মধ্যকার শব্দ/বাক্যগুলো মূল লেখকের, তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরকারগুলো অনুবাদকের। -অনুবাদক
×