ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুলতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫

গুলতি

পাকা ধানের পাকা মৌ মৌ গন্ধ। শীতের আমেজ। ঘন কুয়াশায় ঢাকা গ্রাম-মাঠ, ও পথ-ঘাট। কৃষকের ঘরে আনন্দের সুর। খেজুররসের সঙ্গে নতুন চালের পিঠা খাওয়ার ধুম। নবান্নের উৎসবটা ভালই জমবে। বাবা বলেছে, ধান কাটা শেষে রতনকে নতুন জামা কিনে দেবেন। লেখাপড়ার ফাঁকে সে বাবাকে কাজে সাহায্য করে। ভাত দিতে গিয়ে ক’আটি ধান কেটে দেয়। বাবা গামছা বিছিয়ে নদীর পাড়ে একটু জিরিয়ে নেয়। ভাবে, আমার ছেলেটা খুব ভালা। ফাইভে পড়ে। এই বয়সে সংসারের প্রতি কত মায়া! গর্বে বাবার বুকটা ভরে উঠে। ধান কাটতে গিয়ে রতন একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। অনেকগুলো পাখি উড়ে এসে বিলের মধ্যে বসছে। শালিক, বক, ময়না, টিয়া, চড়ই। পাখিগুলোও নতুন ধানের উৎসবে মেতেছে। এ-বিল ও-বিল উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের নড়াছড়া দেখে গাছে গিয়ে বসছে। পোকামাকড় আর ঝরেপড়া ধানগুলো খাচ্ছে। ঝরেপড়া ধান কুড়াচ্ছে একদল ছেলে। ধান দিয়ে গোপাল ময়রা থেকে মুড়ি বাতাসা খাবে। শুকনো নাড়া কেটে জড়ো করছে রতনের বন্ধু যোগেন, তপু। পাখিগুলোকে দেখে সবার খুব আনন্দ হয়। অচেনা পাখিও আছে। যেগুলো সচরাচর দেখা যায় না। শিক্ষক বলেছেন, এগুলো অতিথি পাখি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। আবার চলেও যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে এত পাখি ওরা কখনও দেখেনি। বন্ধুরা মিলে বুদ্ধি করল, পাখি শিকার করবে। সবার গুলতি আছে। যোগেনের নিশাটাও ভাল। আগে মাটির গুলি বানাতে হবে। ওরা জমি থেকে হালকা নরম মাটি নিল। তারপর নাড়ার আগুন জ্বালাল। মার্বেলের মতো করে পাকানো কাঁচা গুলিগুলো পোড়াতে দিল। গুলিগুলো লাল হয়ে শক্ত পাথরের মতো হয়েছে। যোগেন টিপে দেখে বলল- একদম ঠিক হয়েছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। কে কয়টা পাখি মারবে তাই ভাবছে। সকালে সবাই নদীর পাড়ে দেখল কোন পাখি নেই। রতন বলল, দুপুরের পরে ঠিকই ধান খেতে আসবে। হাতের কাছে দু’্একটা পাখি পেলেও নিশানা ব্যর্থ হচ্ছে। গুলতি ছোড়ার আগেই ফুড়–ৎ করে উড়ে যাচ্ছে। যতবারই ব্যর্থ হচ্ছে ততবারই তপু বলছে- ভাবিস না দোস্ত। ঠিকই লেগেছে। তবে এখন নয়, বাসায় গিয়ে মরবে। যোগেনের খুব রাগ হয়। সবার হাতেই গুলতি। পাখি দেখলেই সবাই গুলতি তাক্ করে। কিন্তু কেউ নিশানা ঠিক করে পাখি শিকার করতে পারছে না। ওরা নদীর পাড় ধরে অনেকদূর চলে এসেছে। সামনেই একটা বড় হিজল গাছে। গাছের ডালে একটা সাদা ধলি বক। ধলি বক অনেক বড় হয়। অনেক্ষণ এক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বকটি মাছ শিকারে বসেছে। নদীতে স্রোত নেই। মাছের নড়াচড়াও নেই। বকটারও অন্যদিকে খেয়াল নেই। শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিন বন্ধু তিন দিক থেকে নিশানা তাক্ করেছে। বকটা নিশ্চিত শিকার হবে। যোগেনের মনে খুব আনন্দ, লাগলে তার গুলিটাই লাগবে। বকটি লম্বা গলাটা একবার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে টুপ করে জলে নেমে পড়ল। কিন্তু কী আশ্চার্য! সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের মাঝখানে একটা পুঁটিমাছ ধরে আবার হিজল গাছের মগডালে গিয়ে বসল। নিশানা পাল্টাতে হলো। সবারই মন খারাপ। আজ বুঝি আর শিকার হবে না। কাল আবার বের হতে হবে। বকটি যে ডালে বসেছে তার পাশেই একটা পাখির বাসা। তাতে ধবধবে সাদা দু’টো বকের ছানা। শুধু লালচে ঠোঁট দুটো দেখা যাচ্ছে। মা বকটি পুঁটিমাছটা একটা বাচ্চার মুখে পুড়ে দিল। অন্য বাচ্চাটা চিঁ-চিঁ করে নড়ে উঠল। বলছে, আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আমাকে খেতে দাও। আমিও পুঁটিমাছ খাব। এই শুনে মা বকটি আবার নদীর পাড়ে এসে বসেছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠল যোগেন। শিকার একেবারে হাতের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে গুলতি তাক্ করল। এবার নিশ্চিত বকটি মারা যাবে। তপু কখনও বলতে পারবে না, বকটি বাসায় গিয়ে মরবে। রতন গুলতি ধরেনি। কী যেন ভাবছে। সে গাছের ওপড়ে বাচ্চাগুলোকে দেখল। খুব মায়া হচ্ছে। ভাবল, মা বকটি যদি মরে যায় তাহলে বাচ্চাগুলোর কী হবে? বাচ্চাগুলো উড়তে জানে না। মা বকটা একজনকে খাইয়ে অন্য বাচ্চার জন্য খাবার যোগাড় করতে এসেছে। এই অবস্থায় মা বকটাকে মেরে ফেলাটা মোটেও ভাল হবে না। মার জন্য ছোট বাচ্চাটাও না খেয়ে থাকবে। রতন মনের কথাটা বন্ধুদের বুঝিয়ে বলল। ঠিক তখনি মা বকটা টুপ করে একটা পুঁটিমাছ ধরে অন্য বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর জন্য উড়ে গেল।
×