ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুঁড়িয়ে দেয়া শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে

বগুড়ার সেই কারুপল্লী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫

বগুড়ার  সেই কারুপল্লী

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার সেই কারুপল্লী ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবে কৃতিশিল্পীর অযতেœ ফেলে দেয়া সৃষ্টিশীল কাজগুলোর কিছু অংশ সযতেœ মর্যাদা পেয়েছে। মহৎ এ কাজ করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এ অঞ্চলের প্রাচীন এ্যাডওয়ার্ড পার্কের একাংশের সেডে কৃত্রিম চিড়িয়াখানার লাইভ সাইজ জীবজন্তুগুলোকে সাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পার্কের সৌন্দর্যও বেড়েছে। বগুড়া শহরের নওয়াব পরিবারের একজন সদস্য ৮০’র দশকের শুরুতে নওয়াব প্যালেসের একাংশকে সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম স্থাপনের জন্য লিজ দেন বগুড়ার কৃতিশিল্পী আমিনুল করিম দুলালকে। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা (বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ার) থেকে সামান্য পূর্ব দিকে হাঁটা পথের দূরত্বে নওয়াববাড়ি সড়কের ধারেই স্থাপিত হয় শিল্পীর স্বপ্নের শিল্পকর্মের স্থাপনা। নাম দেয়া হয় কারুপল্লী। শিল্পী তার প্রতিটি কাজ এতটাই দৃষ্টিনন্দন করে তুলে ধরেন যা কয়েক মাসের মধ্যে দেশের প্রতিটি স্থানের লোকের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। বগুড়ায় কেউ বেড়াতে এলেই কারুপল্লী দেখা রুটিনের মধ্যে থাকে। কারুপল্লীর বিশাল উন্মুক্ত চত্বরে স্থাপিত হতে থাকে বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, জিরাফ, ক্যাঙারু, গ-ার, জলহস্তি, বানর, হুনুমান, ওরাংওটাং, শিমপাঞ্জি, শিলমাছ পাখিসহ নানা পশু-পাখি। লাইভ সাইজ এ জন্তুগুলো এমনভাবে রাখা হয় মনে হবে যেন দাঁড়িয়ে আছে। নাম দেয়া হয় কৃত্রিম চিড়িয়াখানা। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে কারুপল্লী। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মিলনমেলায় পরিণত হয় এ চত্বর। কেউ প্রাণীর সঙ্গে ছবি তুলতে চ্ইলে কারুপল্লীর আলোকচিত্রীরা তা তুলে দেয়। এজন্য কমার্শিয়াল স্টুডিও বসানো হয়। প্রতিটি প্রাণীর সামনে নামফলকে পরিচিতি লেখা থাকে। যা পাঠ করে শিশু কিশোরররা প্রাণী সম্পর্কে জানতে পারে। কৃত্রিম এ চিড়িয়াখানার পাশেই নির্মিত হয় বিশেষ ধরনের শিল্পকর্ম আজবগুহা। প্রবেশপথ গুহার মতো। অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে হালকা বাতির (ডিম লাইটের মতো) মধ্যে একে একে চারটি কক্ষে প্রবেশ করতে হয়। এসব কক্ষে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সীমিত আলোয় শিল্পকর্ম স্থাপিত হয়। ক্লাসিক্যাল আবহ সঙ্গীতের মধ্যে স্টেরিও সাউন্ডে ধারা বর্ণনায় আদিম মানুষ থেকে কৃষিসভ্যতা হয়ে বর্তমান সভ্যতার ধারা প্রদর্শিত হয়। আজবগুহার প্রবেশ পথে ওপরে আদিম মানুষের হাতে বড় পাথরের বিশাল ভাস্কর্য যাতে লেখা ছিল দাও ফিরে সেই অরণ্য। আজবগুহার ধারেই সেদিনের সেই বায়োস্কোপকে বিরাট আঙ্গিকে নির্মাণ করে চারধারে ৮টি মোটা লেন্স এঁটে ইতিহাস ভিত্তিক ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এমন দৃষ্টিনন্দন ও সৃষ্টিশীল শিল্পের ভুবন গড়ে তোলার বছর কয়েকের মধ্যে শিল্পী দুলালের অকাল প্রয়াণে তার সহচররা এ সৃষ্টিশীল কাজগুলো ধরে রাখার দায়িত্ব নেয়। বছর কয়েক আগে নওয়ার পরিবারের এক সদস্য লিজ দেয়া কারুপল্লীকে অনেকটা গোপনে বিক্রি করে দেয় রানার গ্রুপ নামের বড় এক ডেভলাপার প্রতিষ্ঠানের কাছে। ওই সময় কারুপল্লীকে রক্ষায় বগুড়ার মানুষ পথে নেমেছিল। মানববন্ধন করেছিল। ঠেকানো যায়নি। অর্থলোললুপ মানুষের কাছে শিল্পীর সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম হেরে যায়। রানার গ্রুপ যেদিন বুলডোজার নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য কারুপল্লীর আজবগুহা বায়োস্কোপ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিম চিড়িয়াখানার কিছু প্রাণীকে শাবলের আঘাতে ভেঙ্গে ফেলতে থাকে তখন বগুড়ার কয়েক সুধীজন পৌরসভার মেয়রের কাছে গিয়ে শিল্পীর অন্তত কিছু কাজকে রক্ষার অনুরোধ জানায়। মেয়র মাহবুবুর রহমান কর্তৃপক্ষের কাছে দু’দিনের সময় নিয়ে অক্ষত ভাস্কর্যগুলোর ওপর আর আঘাত না করার অনুরোধ জানিয়ে নিজ উদ্যোগে তা এ্যাডওয়ার্ড পার্কের ভিতরে এনে রাখেন। শিল্পকর্মগুলো সেখানেও কিছুদিন পড়ে থাকে। পার্কে বেড়াতে আসা লোকজন ও শিশু-কিশোর পড়ে থাকা জীবজন্তুগুলোকে দেখে কারুপল্লীর কথা স্মরণ করে। কিছুদিন আগে পৌরমেয়র মাহবুবুর রহমান উদ্যোগ নিয়ে কৃত্রিম চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোকে মাটি থেকে তুলে দর্শনীয় করে রাখতে সেড নির্মাণ করেন। তারপর সেডটিকে উন্নত করে বড় ঘর বানান। চারধারে কিছু অংশ কনস্ট্রাকশনে ঘিরে ওপরের অংশে গ্রীলে আটকে বাইরে থেকেও দেখার ব্যবস্থা করা হয়। বিকেলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। কৃত্রিম চিড়িয়াখানার এই প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন দু’জন। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে বগুড়া শহরের ভিতরে গোহাইল রোডর ধারে দশ বিঘা জমির ওপর সপ্তম সম্রাট এ্যাডওয়ার্ডের নামে প্রতিষ্ঠিত পার্ককে হালে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। আনন্দ সরোবর, কৃত্রিম পাহাড়, আম্রকানন, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাম গাছের সারি, ঘূর্ণায়মান ফোয়ারা বাহারি ফুলের বাগান সবুজ ঘাসের ওপর বসার ছাতা সেডসহ নানা আয়োজনের মধ্যে আম্রকাননের এক ধারে বিশেষ ধরনের সেডের মধ্যে রাখা হয়েছে বগুড়ার সৃষ্টিশীল প্রয়াত শিল্পী আমিনুল করিম দুলালের শিল্পকর্মগুলো। পৌর কর্তৃপক্ষ কংক্রিটের বনের নির্মাতাদের শাবলের হাত থেকে সৃষ্টিশীল শিল্পীর কাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ রক্ষা করে প্রকৃতির বনে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বগুড়ার মানুষের কাছে প্রিয় এ পার্কে ভ্রমণার্থীরা নিত্যদিন দেখে শিল্পীর শিল্পকর্ম।
×