ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাপস মজুমদার

খাদ্যপণ্যের দাম ও বায়োফুয়েল

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

খাদ্যপণ্যের দাম ও বায়োফুয়েল

গত সংখ্যায় প্যারিসে চলমান জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কারণের মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম। এর সমর্থনে দেখতে পাচ্ছি, ব্রিটেনের যুবরাজ প্রিন্স চার্লস সম্প্রতি স্কাই নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সেখানে চার বছর ধরে চলা এক খরা।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, আল গোর, ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মার্টিন ও’ম্যালি এবং বার্নি স্যান্ডার্সও এই মতের সমর্থক। শেষোক্তজন তো আরও একধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের সম্পর্ক আছে। অবশ্য পরিবেশবিদ ও আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন যে, এর পেছনে বিজ্ঞানের চেয়ে রাজনীতি বেশি কাজ করেছে। সত্য বটে, প্যারিসে চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের আলাপ-আলোচনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে আমরা বিজ্ঞানের চেয়ে রাজনীতির প্রভাবই বেশি দেখতে পাচ্ছি। এও সত্য যে, সিরিয়ার দারফুরে কয়েক বছর খরা হয়েছিল। এর ফলে ১৫ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তবে ২০০৯ সালে ডিজেল ও সারের ওপর থেকে রাতারাতি ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলেও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। সাধারণ মানুষের কাছে ভর্তুকি হ্রাসের বিষয়টি ছিল খরার চেয়েও দুর্বিষহ। ফলে গৃহযুদ্ধ ও অভিবাসন প্রক্রিয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের প্রত্যক্ষ ইন্ধন তো ছিলই। জলবায়ু পরিবর্তন যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটায়, এও তো অসত্য নয়। সিরিয়ায় এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আসাদ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে বলেন যে, ইউরোপ-আমেরিকায় যে লাখ লাখ শরণার্থী ঢুকে পড়েছে, তাদের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী এমনকি আইএস জঙ্গীও রয়েছে। ইতোমধ্যে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় এর প্রমাণ মিলেছে। আগামীতে অন্যত্রও যে মিলবে না কে জানে! নীলনদের পানির হিস্যা নিয়ে মিসর-সুদানের যুদ্ধের কথা কমবেশি সবারই জানা। সর্বশেষ, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস, আগামীতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধেই যায়, তাহলে তার অন্যতম প্রধান একটি ইস্যু হবে পানির হিস্যা। এ বিষয়ে অলমিতি বিস্তরেণ। ২. এবার লেখার বিষয় মূলত দ্রব্যমূল্য। সন্দেহ নেই যে, লেখালেখির জন্য এটি একটি নাজুক বিষয়। অপ্রিয় ও সত্য ভাষণ লিখতে গেলে প্রায়ই তা কোন না কোন দিকে হেলে পড়ে। ফলে স্বভাবতই অন্য পক্ষ মর্মাহত হন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি কিছুটা সুস্পষ্ট হতে পারে। যদি আমরা লিখি যে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম কম, তাহলে পাঠক সাধারণভাবে মনঃক্ষুণœ হতে পারেন। মানুষের একটি বেসিক প্রবণতা, যা আদিকাল থেকেই চলে আসছে, তা হলো সে সস্তায় জিনিস কিনতে চায়, পেতে চায়। বাজার, চাহিদা, যোগান, আমদানি-রফতানি, পাইকারি মূল্য, খুচরা মূল্য, লাভ-ক্ষতি, এলসি, ব্যাংকঋণ. সুদকষা ইত্যাদি সে বোঝে না। বুঝতে চায় না। কেউ কেউ বুঝলেও বাজার করার সময় অন্তত ভুলে থাকতে চায়। কেননা তার পকেট সীমিত। অথচ বাজার করতে গিয়ে চেতনে-অচেতনে নানা আশা-আকাক্সক্ষা কাজ করে থাকে। তদুপরি যে কোন পণ্য কিনে সেটির দাম, ন্যায্যমূল্য, সঙ্গতি, সর্বোপরি পরিতৃপ্তির ব্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন বাজার করতে গিয়ে যথাযথ পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফেরা ঘটে খুব কমই। এখানে খুব ধনী ও সচ্ছলদের কথা বলা হচ্ছে না কিন্তু। বলা হচ্ছে নিতান্তই ছাপোষা মানুষ ও মধ্যবিত্তের কথা। যারা একরাশ আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বাজারে যান থলে ভর্তি বাজার নিয়ে ফিরবেন বলে এবং শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন ব্যর্থ মনোরথ হয়ে। এর পাশাপাশি এক বুক হতাশা, দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস, ব্যবসায়ীদের তথা বিক্রেতাদের শাপশাপান্ত এবং সর্বোপরি সরকারের তুখোড় সমালোচনা তো আছেই। সমস্যা আছে অন্যত্রও। প্রায় সবাই বুঝি ভাবেন, ইতিহাসে পড়া শায়েস্তা খানের আমল বুঝি চলমান! চাইলেই বুঝি এক টাকায় চাল-ডাল-মাছ-মুরগি-খাসি নিয়ে আসতে পারবেন বাজার থেকে! একবারও কিন্তু ভাবেন না যে, শায়েস্তা খানের আমলেও বঙ্গদেশের অনেক মানুষ না খেয়ে থাকত, তাদের অনেকের কাছে টাকা তো আকাশ-কুসুম কল্পনা; ফুটো পয়সা পর্যন্ত থাকত না। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে এবং তারও অনেক আগে চর্যাপদের সাহিত্যে না খেতে পাওয়া মানুষের করুণ কাহিনী আছে অনেক। সুতরাং এখনও যে মিলবে, তাতে আর বিচিত্র কী। তবে আশার কথা হলো এই যে, গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা আজকাল তাদের কথা জানতে পারি সহজেই। উত্তরবঙ্গ বা অন্য কোথাও কেউ বা কোন জনপদ মঙ্গাক্রান্ত হলে খুব সহজেই তার সচিত্র সংবাদ মেলে এবং প্রতিকারও জোটে। চীনের নীরব দুর্ভিক্ষের খবর আমরা জানতে পারি অমর্ত্য সেনের লেখার মাধ্যমে। অনুরূপ সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ, বায়াফ্রার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, হাইতির খাদ্যদাঙ্গা এবং সর্বশেষ নিথর নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ বেলাভূমিতে একেবারে নিরপরাধ নিষ্পাপ শিশু আইলানের মরদেহ স্পষ্টতই বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে যায় গণমাধ্যমের কল্যাণে। এখানেও সেই জলবায়ু উদ্বাস্তু। যা হোক, মোদ্দাকথা হলো, পৃথিবীতে সস্তার যুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই এবং বিশ্বায়নের যুগে সাত শ’কোটি মানুষ দুই শতাধিক পৃথক রাষ্ট্র বা দেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও কমবেশি বিশ্বব্যাপী প্রলম্বিত ও চলমান একটি বৃহৎ বাজারের অংশীদার। সে কারণেই বলব, সস্তার দিন শেষ, আসছে মাগ্গিগ-ার দিন। তারপরও যে এই রাজধানীতে, এই ঢাকা শহরে মাত্র তিন টাকায় একটি পুরি কিংবা সিঙ্গারা পাওয়া যায়, চার-পাঁচ টাকায় একটি রুটি কিংবা পরোটা-অবাক মানতে হয় বৈকি। এর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। পাঠক, মনে রাখবেন, ওতেও কিন্তু বিক্রেতার লাভ থাকে এবং তা পর্যায়ক্রমে বণ্টিত হয়ে থাকে জ্বালানি, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, সবজি ও শ্রমের ভিত্তিতে। তারপরেও বলব, আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি, অন্তত বৈশ্বিক বাজারের তুলনায়। তদুপরি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। বাজার বিশ্লেষকরা এর নানা কারণ খুঁজে বের করতে পারেন। তবে মোটা দাগে বলা যায় যে, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে আদৌ কোন মনিটরিং না থাকায় এখানে একটি লাগামহীন মনোভাব কাজ করছে। অর্থাৎ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার প্রবণতা বেশি। একথা খুচরা এবং পাইকারি উভয় শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য। প্রধান খাদ্যপণ্য চাল নিয়ে সময়ান্তরে আলাদা একটি লেখায় কথা চালাচালি করব। আপাতত বলি গম, চিনি ও ভোজ্যতেল নিয়ে। ঢাকার বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত এক বছরে তেল, চিনি ও গমের দাম বিশ্ববাজারে এবং দেশে কত কমেছে তার একটি হিসাব পাওয়া গেছে। তাতে সংস্থাটি বলেছে, এক বছরে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে ২৭ শতাংশ, কিন্তু দেশে কমেছে ৬ শতাংশ, সয়াবিন তেল ১৯ শতাংশ, দেশে ৬ শতাংশ, গম ২৮ শতাংশ, দেশে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে সেই অনুপাতে দাম কমে না। অথচ ট্র্যাজেডি হলো, দেশে এ তিনটি পণ্যের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা প্রায়ই দোহাই দেয় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে খাদ্যপণ্যের পরিমাণ ছিল ১৪ শতাংশ। এবং আর যত খাদ্যপণ্য আমদানি হয়েছে তার ৭২ শতাংশই হলো গম, চিনি ও ভোজ্যতেল। সুতরাং মুনাফার পরিমাণও সহজেই অনুমেয়। এ প্রসঙ্গে গুঁড়া দুধ ও শিশু খাদ্যের উল্লেখ করতেই হয়। সম্ভবত এ দুটো পণ্যে সর্বাধিক নয়ছয় ও মুনাফা লুটেপুটে থাকে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে বারান্তরে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় এও দেখা গেছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ে ১ মাস ২৪ দিনের মধ্যে। কিন্তু বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমলে দেশে দাম কমতে সময় নেয় ২ মাস ৬ দিন। একইভাবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে দেশে বাড়তে লাগে সাড়ে চার মাস। তবে কমতে সময় লাগে ৬ মাস ৯ দিন। অনুরূপ গমের ক্ষেত্রে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ে ২ মাস ২৭ দিনে। অন্যদিকে দাম কমলে দেশে দাম কমতে লেগে যায় ৫ মাস ৯ দিন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা নিজেদের ইচ্ছামতো এবং মর্জিমাফিক কাজে লাগিয়ে থাকেন। পৃথিবীতে সস্তার দিন আর ফিরে আসবে না বলায় যে বা যারা মন খারাপ করে বসে আছেন, তাদের জন্য একটি টিপস দেই। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তীব্র জ্বালানি চাহিদা মেটানোর তাগিদ থেকে সৃষ্ট সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হলো বায়োফুয়েল- মিথানল, ইথানল। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও ব্রাজিলে এর ব্যবহার ১৫-২০ শতাংশ। এর অন্যতম কাঁচামাল হলো ধান, গম, ভুট্টা, বার্লি, চিনি, সয়াবিন ইত্যাদি। দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এর অনেকটাই বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বায়োফুয়েল তৈরির উপাদান হিসেবে। অন্যদিকে কৃষি জমির পরিমাণও কমছে নানাভাবে, নানা উপায়ে। সুতরাং খাদ্যপণ্যের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে। পাঠক, নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরতে পেরেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের প্রসঙ্গটি।
×