ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফুয়েলচার্জের নামে টাকা পাচার করছে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

ফুয়েলচার্জের নামে টাকা পাচার করছে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এয়ারলাইন্সগুলোর মুদ্রা পাচার, ট্যাক্সফাঁকি ও অন্যান্য দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ, তা শুধু সাধারণ মানুষই নয়- সচেতন মহলও অন্ধকারে। আর যারা এর দেখভালের দায়িত্বে সেই সিভিল এভিয়েশনের কিছু সংখ্যক লোক এতে মদদ দেয়। যেমন বছরের পর বছর ধরে ফুয়েল চার্জের নামে যেভাবে কয়েকটি এয়ারলাইন্স বিদেশে টাকা পাচার করছে-তা রীতিমতো বিস্ময়কর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই এয়ারলাইন্সগুলো চালাচ্ছে তুঘলকি কা-। এ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেলস এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এমনই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। সংগঠনটির সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোরশেদ মাহবুব তথ্য প্রমাণাদি সহকারে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন অনেক অজানা তথ্য। কি সেই তথ্য? যেমন-মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ঢাকা-কুয়ালালামপুর ফ্লাইটে যাত্রীভাড়া ১৪,৩১৯ টাকা। আর ট্যাক্স ১৬,৫৬৪ টাকা। অবাক করা এ কা- শুধু মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সেরই নয়। ২৬টি এয়ারলাইন্স শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সারচার্জের নামে এ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। আর যাত্রীদের দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ট্যাক্সের নামে এই সারচার্জ বন্ধে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু কোন এয়ারলাইন্সই তা আমলে নিচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- সাম্প্রতিক কয়েকটি এয়ারলাইন্স টিকিট মূল্যের ক্ষেত্রে ভাড়ার পরিমাণ কমিয়ে ফুয়েল সারচার্জের (ওয়াইকিউ/ওয়াইআর) নামে ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো ভাড়ার ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৬০% ফুয়েল সারচার্জ দেখিয়ে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। আর এভাবে ট্যাক্সের নামে প্রচুর অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। তাদের মধ্যে সবার শীর্ষে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, ইতিহাদ, এমিরেটস কাতার ব্যাংকক এয়ারওয়েজ, থাই এয়ারওয়েজ ও চায়না ইস্টার্ন। যে কারণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ফুয়েল সারচার্জকে মূল ভাড়ার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রায় এক বছর আগে নির্দেশনা দেয়। এসব নিয়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে এ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট আটাবের একাধিক বৈঠক হওয়ার পরও সমাধান হয়নি। বরং তারা এদেশের সব আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেকটা গায়ের জোরেই এ ধরনের জালিয়াতি ও মুদ্রা পাচারের মতো অপরাধ করছে। আসলে ফুয়েল চার্জ আদায়ের নামে তারা রীতিমতো এ দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০১৪ সালের ১৬ নবেম্বর বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ ২৬ দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সকে এক চিঠির মাধ্যমে ফুয়েল সারচার্জকে মূল ভাড়ার অন্তর্ভুক্ত করা এবং সে অনুযায়ী এজেন্সিগুলোকে কমিশন দেয়ার নির্দেশ দেয়। বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফ্লাইট সেপটি এ্যান্ড রেগুলেশন্স) গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম নাজমুল আনাম স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় এয়ারলাইন্স পরিচালনাকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘আইএটিএ’-এর রেজুলেশন উল্লেখ করে বলা হয়, ফুয়েল সারসার্জ কোনভাবেই সরকারী কোন ট্যাক্স বা ব্যাগেজ চার্জের পর্যায়ে পড়ে না। ফলে ভাড়ায় উল্লেখিত ফুয়েল সারচার্জের ওপর ট্রাভেল এজেন্সিগুলো কমিশন পাওয়ার অধিকার রাখে। নির্দেশনায় এজেন্সিগুলোকে সারচার্জসহ ভাড়ার ওপর কমিশন দেয়া অথবা সারচার্জকে ভাড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। তবে এই নির্দেশনা জারির এক বছর পার হলেও এয়ারলাইন্সগুলো তা বাস্তবায়ন করেনি। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্টেশন এ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে চলমান এয়ারলাইন্সগুলো গড়ে ৪৫% হারে সারচার্জ দেখিয়ে ২০১৩ সালে ১৭০০ কোটি, ২০১৪ সালে ১৮৮৩ কোটি এবং চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১১৬ কোটি টাকার রাজস্ব এবং কমিশন ফাঁকি দিয়েছে। এই টাকায় ৭% হারে কমিশন ধরলে এজেন্সিগুলো যথাক্রমে ১১৯ কোটি, ১৩১ কোটি ও ৮২ কোটি টাকার কমিশন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে সরকার এই ৩৬৯৯ কোটি টাকার বিপরীতে এক টাকা ট্যাক্সও পায়নি। কারণ ট্যাক্স হিসেবে দেখানো টাকার ওপর ট্যাক্স ধরা হয় না। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আটাবের পক্ষ থেকে গত ২৪ নবেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে দেশ থেকে ফুয়েল সারচার্জের নামে এয়ারটিকিট মূল্যের অর্ধেকেরও বেশি ট্যাক্স ছাড়াই বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তাতে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর-ঢাকা টিকিট মূল্যের ৬০% সারচার্জ হিসেবে ধরা হয়। মোট ভাড়া যেখানে ৩৬ হাজার ৪৫৬ টাকা সেখানে মূল ভাড়া ধরা হয় ১৪ হাজার ৩১৯ টাকা। আর ফুয়েল সারচার্জ ১৬ হাজার ৫৬৪ টাকা এবং সরকারী ট্যাক্স ফি ধরা হয় ৫৫৭৩ টাকা। কিন্তু কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকা-কুয়ালালামপুরের টিকিটের ক্ষেত্রে ভাড়ার মাত্র ১৬% সারচার্জ দেখানো হয়। মোট ভাড়া যেখানে ৩৪ হাজার ৫২ টাকা- সেখানে মূল ভাড়া ধরা হয় ৩২ হাজার ১৬৯ টাকা, ফুয়েল সারচার্জ ধরা হয় মাত্র ৩১০ টাকা এবং সরকারী ট্যাক্স ও অন্যান্য ফি ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৩ টাকা। একইভাবে আমিরাত এয়ারলাইন্সের ঢাকা-নিউইয়র্ক-ঢাকার একটি টিকিটের মূল্যে দেখা যায় মোট ভাড়ার ৪১% ফুয়েল সারচার্জ ধরা হয়। এভাবে ফুয়েল সারচার্জের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা ট্যাক্স ছাড়াই বিদেশে চলে যাচ্ছে। আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব সংবাদ সম্মেলনে আরও উল্লেখ করেন, এয়ারলাইন্সগুলো দীর্ঘদিন ধরে ফুয়েল সারচার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ।
×