ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জট এখনই খুলছে না ॥ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫

জট এখনই খুলছে না ॥ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের অপেক্ষায়

ফিরোজ মান্না ॥ দেশের নিরাপত্তার ইস্যুতে ফেসবুক বন্ধ করা হলেও কবে তা খুলে দেয়া হবে তার দিনক্ষণ বলা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বলছে খুব শীঘ্রই ফেসবুক খুলে দেয়া হবে। এই শীঘ্রই আসলে কত সময়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কবে ফেসবুক খোলা হবে? অনির্দিষ্টকালের জন্য সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় এ মাধ্যম বন্ধ রেখে দেশের আর্থিক ক্ষতিসহ বিশাল তরুণ প্রজন্ম নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তা ঢাকায় তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করলেও ফেসবুক কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। তবে ফেসবুক কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে বলেছেন কোন কোন বিষয়ে তারা কী করতে পারবেন, আর কোন কোন বিষয়ে তারা কিছু করতে পারবেন না। বক্তব্য দিয়েছেন কেবল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ফেসবুকের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তারা আমাদের দাবিগুলো বিবেচনায় নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এই আশ্বাসের কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তার ওপর ভিত্তি করে ফেসবুক খুলে দেয়া হবে। ঢাকায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পর আসলে তারা কী বলেছেন- বিষয়টি জানার জন্য বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব কর্তৃপক্ষই বলেছে, যে কোন সময় ফেসবুক খুলে দেয়া হবে। আমাদের আলোচনা সফল হয়েছে। চূড়ান্তভাবে কিছু না হলেও আগামী জানুয়ারিতে ফেসবুকের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি হবে। চুক্তি হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তখন আমাদের সাইবার নিরাপত্তা অনেক জোরদার করা সম্ভব হবে। ফেসবুক বন্ধ থাকায় দেশের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ সময় ধরে চরম সঙ্কটে কাটাতে হচ্ছে। শুধু ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই যে প্রভাব পড়েছে তা নয়, এর প্রভাব তরুণ সমাজে আরও প্রকট আকারে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যম দিয়ে দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে না। দীর্ঘ সময় ফেসবুক বন্ধ থাকায় সরকারের প্রতি একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বিরূপ হয়ে পড়েছে। দেশে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার পর থেকে ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্স ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমে এসেছে। শনিবার শাহবাগে ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন করে তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে এ পর্যন্ত তাদের ২শ’ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসা কমেছে মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্র্যান্ডউইথ ব্যবসায়ীদেরও। মোবাইল ফোন অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিদিনই তাদের সাড়ে ৪শ’ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হতো। এখন ফেসবুক বন্ধের পর ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ৩শ’ টেরাবাইটের নিচে নেমে এসেছে। গ্রামীণফোনের হেড অব কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসাইন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগ সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন। এটি একটি খুবই জনপ্রিয় এ্যাপস। এটি বন্ধ থাকায় ব্যান্ডউইথের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। ফলে অন্য গ্রাহকরা ব্রাউজিংয়ে গতি বেশি পাচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, ফেসবুক বন্ধ না করে বাঁশের কেল্লা বন্ধ করেন। তাদের একটি পেজের এ্যাডমিনকে আটক করার পরিবর্তে ফেসবুক খুলে দিয়ে তাদের আরও ৫১ পেজ চালায় এমন ৫১ জনকে আটক করা সম্ভব হবে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসসি) ফেস্টিভ্যালে বক্তৃতার সময় ফেসবুক বন্ধের অর্জন শূন্য বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমি বাঁশের কেল্লার ৫২ পেজ দেখেছি। এতদিন বন্ধ রেখে মাত্র একজনকে ধরা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫১ পেজের এ্যাডমিনকে ধরা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, সামাজিক যোগাযোগসহ অন্যান্য কোন সাইট বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রযুক্তি দিয়ে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অন্য কোন উপায়ে কোন প্রযুক্তি বন্ধ করে রাখা যায় না। এদিকে রবিবার ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। বৈঠকে আইজিপিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে যার যার জায়গা থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের কাছে নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, খুব শীঘ্রই ফেসবুক খুলে দেয়া হবে। ফেসবুক প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, ফেসবুক জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যাতে হুমকি না হয়। তারা আমাদের কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। ফেসবুক প্রতিনিধিরা এসব বিষয় শুনেছেন এবং তারা আমাদের অনেক দাবির নোটও নিয়েছেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ফেসবুকের মাধ্যমে নারীর প্রতি হয়রানি, ধর্মীয় উস্কানি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো ঠেকাতে বিশদ আলোচনা হয়। ফেসবুক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আলোচনায় ফেসবুকের পক্ষে ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার পলিসি ম্যানেজার দিপালী লিবারহেন এবং রাজনৈতিক ও আইন উপদেষ্টা বিক্রম লাং। বৈঠকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানিয়েছে, নারীর প্রতি হয়রানি, ধর্মীয় উস্কানি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো ঠেকাতে ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য গত ৩০ নবেম্বর ফেসবুকের এশিয়া-প্যাসিফিক কার্যালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বাংলাদেশে ফেসবুকের অপব্যবহারসহ নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। এরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের চিঠির সাড়া দিয়ে গত শনিবার ফেসবুকের দুই কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন। যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দিন ১৮ নবেম্বর থেকে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নারীর প্রতি হয়রানি, ধর্মীয় উস্কানি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো ঠেকাতে সরকার বেশ আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। এবার ফেসবুকের সঙ্গে আলোচনার পর একটা জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর আগে দেশ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানা অভিযোগ দায়ের করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। তারা সাফ জবাব দিয়েছে তারা শুধু আমেরিকার পেজগুলোই মনিটর করে। অন্য দেশের এ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের কোন পোস্ট মনিটর করে না। অনেক আপত্তিকর বিষয় নিয়ে এর আগে বিটিআরসি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে। কিন্তু কোন অভিযোগ তারা আমলে নেয়নি। দুই-একটা অভিযোগ আমলে নিলেও সেগুলোর জন্য তারা আদালতে মামলা হয়েছে কিনা, আবার মামলা হলেও মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়েছে কিনা- এমন সব কাগজপত্র চেয়ে বসে। সব কাগজ দিলেই যে ওই ব্যক্তির এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা কনটেন্ট মুছে দেবে- তাও তারা দিতে বাধ্য নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। ফেসবুক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ফেসবুক। বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে সাময়িকভাবে ফেসবুক বন্ধ রেখেছি। যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তারা কথা বলছেন- কবে খুলবেন। তা নিয়েই এ আলোচনা। আমাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী প্রয়োজন তা আমরা জানাতে পেরেছি। ফেসবুক কর্মকর্তারা আমাদের কথা শুনেছেন। তারা কতটুকু সহযোগিতা করতে পারবেন তাদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। আমরা পর্যালোচনা করে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেব। তবে কবে কখন ফেসবুক খোলা হবে, তা পরে গণমাধ্যমকে জানানো হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শুধু এটুকু বলব- আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। বিকল্প পথে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে নিরাপত্তার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের যুবসমাজ অনেক ট্যালেন্ট। যুবসমাজের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অনেক আশা-ভরসা। যারা বিকল্প পথে ফেসবুক খুলছেন সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা অফিসিয়ালি তাড়াতাড়িই জানিয়ে দেব।
×