ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেসরকারী স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের শূন্য পদের তালিকা হচ্ছে

শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে পিএসসির আদলে পৃথক কমিশন

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫

শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে পিএসসির আদলে পৃথক কমিশন

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নিয়োগে ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারেই বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সারাদেশের এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষকের শূন্যপদের সঠিক তালিকা করছে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। জানা গেছে, সরকারী কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) আদলে পৃথক একটি স্বাধীন শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের আগেই শিক্ষকদের শূন্যপদের তালিকা চূড়ান্ত করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কতজন শিক্ষকের পদ শূন্য হবে তার সঠিক তালিকা চেয়ে জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য পাঠানো শুরু করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে ৩০ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য কোয়ালিটি টিচার দরকার। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন গঠন করে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি সংসদ সদস্যরা অনেকে নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে সংসদে আপত্তি জানালেও দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, বেসরকারী এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগে সরকারী কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) আদলে শীঘ্রই পৃথক একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এ কমিশনের নাম হবে বেসরকারী শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি)। কমিশন হলে আগের মতো আর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্যপদের ভিত্তিতে কমিশনই পরীক্ষার মাধ্যমে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষক নির্বাচন করবে। এ কমিশন গঠিত হলে নিয়োগের বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদ বা গবর্নিং বডির কর্তৃত্ব থাকবে না। গবর্নিং বডি কেবল কমিশনের দেয়া মেধাক্রম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেবে। বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) অধীনে একটি পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা বিভিন্ন বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকে পরিচালনা কমিটির হাতেই। এতে নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষানীতির সুপারিশের পর ২০১১ সালে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি পৃথক শিক্ষা কর্ম-কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে সে সময় সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষকদের জন্য একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়ায় দুই বছর ধরে ফাইল চালাচালি হলেও সফল হয়নি সরকার। সরকারী শিক্ষকদের আপত্তি ও বেসরকারী শিক্ষকদের বিষয়টি ভালভাবে স্পষ্ট না করায় জটিলতা দেখা দেয়। ওই সময় একটি খসড়া সচিব কমিটি পর্যন্তও গড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্যোগ পুরোপুরি ঝুলে যায়। তবে এবার কেবল বেসরকারী শিক্ষকদের জন্যই হচ্ছে কমিশন। নামও চূড়ান্ত করা হয়েছে। মানসম্মত ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, স্বচ্ছতা আনয়ন তথা দেশের সার্বিক শিক্ষার উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে দেশের প্রতিটি শিক্ষানীতি ও রিপোর্টে আলাদা একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কমিশন হবে বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) থেকে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান। যেটি কেবল বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগের কাজ করবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকল মহলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এবার দ্রুত কাজ করতে চায় সরকার। দেশে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্যদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এমপি, নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকেন তাদের নেতারা পরিচালনা পর্ষদে চলে আসেন। শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া এতদিন তাদের হাত দিয়েই শেষ হতো, যা নিয়ে ‘নিয়োগবাণিজ্য’সহ বিভিন্ন অভিযোগ চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন প্রতিষ্ঠান এনটিএসসি গঠনের পরে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করা হবে। তবে এনটিআরসিএ-এর অধীনে এর আগে যারা সনদ পেয়েছেন তারাও বেসরকারী শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের মেধা তালিকায় থাকবেন। নতুন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের (উপজেলাভিত্তিক) লোককে ওই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ দেয়া হবে। কোন উপজেলার কোন বিভাগের জন্য যোগ্য শিক্ষক পাওয়া না গেলে নিয়োগ দেয়া হবে পাশের উপজেলা থেকে। পাশের উপজেলায়ও যোগ্য শিক্ষক পাওয়া না গেলে ওই জেলা থেকে শিক্ষক নেয়া হবে। আর জেলায়ও পাওয়া না গেলে ওই বিভাগে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। স্বাধীন কমিশন গঠনের পরে এনটিআরসিএ-এর সনদের মেয়াদ থাকবে তিন বছর। এনটিআরসিএ’র অধীনে এ পর্যন্ত ১২টি পরীক্ষার মাধ্যমে মোট পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৩২৯ জন সনদ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৩ হাজার ৪২ জন শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন। আর এনটিআরসিএ সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে ‘এখনও কোন চাকরি পাননি’ এমন প্রার্থীর সংখ্যা তিন লাখের মতো হতে পারে। এদিকে নতুন পদ্ধতিতে যাওয়ার খবরে সারাদেশে তড়িঘড়ি করে অবৈধ ও অযোগ্যদের নিয়োগের খবরে আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া। গেল ১১ নবেম্বর থেকে আদেশ জারি করে নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এর মধ্যেই সারাদেশের শিক্ষকদের শূন্যপদের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনটিআরসিএ কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, বেসরকারী স্কুল-কলেজের শূন্যপদের সংখ্যা কোনদিন তৈরি করা হয়নি। এটি একটি বড় কাজ। তালিকা হলেই নতুন কমিশন সেখানে নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেবে। শূন্য আসনের তালিকা সম্পর্কে এনটিআরসিএ-এর চেয়ারম্যান এএমএম আজহার রবিবার জনকণ্ঠকে বলেছেন, হ্যাঁ সারাদেশের তালিকা তৈরি হচ্ছে। আমরা চিঠি দেয়ার পর অনেকেই ইতোমধ্যে তথ্য পাঠিয়েছে। এনটিআরসিএ’র সদস্য (শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষামান) সোলতান আহমদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শূন্যপদের ৭টি তথ্যের জন্য একটি নমুনা ফাইলও পাঠানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, কর্মচারী এবং সহকারী গ্রন্থাগারিকদের শূন্যপদের তথ্য নেয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি জারি করা শিক্ষক নিয়োগের নতুন বিধান সংক্রান্ত এসআরও’র কপি উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সরবরাহ করেছে এনটিআরসিএ। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নিবন্ধন পরীক্ষার মেধা তালিকা থেকে এই শূন্যপদের তালিকা অনুযায়ী নিয়োগের জন্য পাঠানো হবে। আর এ কাজটি করবে নতুন কমিশন।
×