হেমন্তের মনোরম নাতিশীতোষ্ণ আমেজ শেষ হতে না হতেই রাজধানীবাসীর অল্পস্বল্প শীত অনুভূত হতে শুরু করেছে। মাঝে-মধ্যে বিশেষ করে রাতেরবেলা বন্ধ রাখতে হয় বাতানুকূল যন্ত্র; কমিয়ে দিতে হয় সিলিং ফ্যানের রেগুলেটর; চাই কি শেষ রাতের দিকে আপাদমস্তক পাতলা একটি চাদর কিংবা কাঁথায় মুড়িয়ে দিতে চায় মন। গলি-গিঞ্জি যানজট-জনজট, ধূলি ও ধোঁয়ায় ধূসরিত সর্বোপরি অগণিত অট্টালিকাশোভিত খোদ রাজধানীতেই যখন এই অবস্থা, তখন বুঝতে আদৌ অসুবিধা হয় না যে, শীত এসে কড়া নাড়ছে দরজায়। অবশ্য ঢাকার বাইরে শহরতলী ও আশপাশে, গ্রাম-গঞ্জে এবং বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শীত বুঝি এসে গেছে কিছু আগেই। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা কুয়াশা পড়ে; দিনেরবেলা অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব এবং হিমরাত প্রলম্বিত। রোদ ওঠে বেলা করে। নবান্নের সুপক্ষ সোনালী ধান এবং গোধূলির রক্তিম আভাসে দেখা মেলে শীতের আগমনীর। জনকণ্ঠের সংবাদদাতা রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র শীতের আমেজ অনুভূত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। শীতকালের আনুষঙ্গিক বিবরণসহ প্রাপ্য উপকরণাদি সম্পর্কেও জানাতে ভোলেননি। একই সঙ্গে পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা হেমন্তের দিনে রক্তিমাভ গোধূলিলগ্নের সুন্দর একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটুকুই কি সব?
আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত ক’বছর ধরেই ঋতু পরিবর্তনের আলামত তথা খামখেয়ালিপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি হয়ত ঠিকই আছে; তবে আবর্তনের নিয়ম মেনে ঋতুগুলো যেন আর আগের মতো যথাসময়ে আসে না। গ্রীষ্মকাল হয় প্রলম্বিত, খরাপ্রবণ, তাপদগ্ধ। ফলে বর্ষার আগমন ঘটে অপেক্ষাকৃত বিলম্বে। কালিদাসের কালের নিয়ম মেনে আষাঢ়ের প্রথম দিবসেই বুঝি আর কদম ফুল ফোটে না। স্বল্পস্থায়ী শরত-হেমন্তের আভাস মেলে স্বচ্ছ নীল আকাশ এবং নবান্নের ঘ্রাণে। তবে সবাইকে বুঝি টেক্কা দিতে চায় শীত ও বসন্ত। শীতকাল এসেই বলে যাই। বিশেষ করে নগরজীবনে বড়জোর দু’চারদিন শৈত্যপ্রবাহ অনুভূত হয় কি হয় না। আর বসন্তকাল! বাংলার এক কবিই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’
আবহাওয়া বিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবই নাকি প্রধানত মনুষ্যসৃষ্ট। মানুষের আত্মঘাতী প্রবণতা। বায়ুম-লে অবিরাম অপরিকল্পিত কার্বন নিঃসরণের পরিণাম। মানুষ তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও আরাম-আয়েশের জন্য গাছপালা-বনাঞ্চল ধ্বংসসহ নানাভাবে নানা উপায়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাচ্ছে। আর এর চূড়ান্ত পরিণামেই ঘটছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় সুমেরু-কুমেরুর বরফ গলে যাচ্ছে; হিমবাহ যাচ্ছে গলে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। মহাসাগরীয় স্রোতে আসছে পরিবর্তন। সুতরাং ঋতুচক্রে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে, তাতে আর বিচিত্র কি? আর এ কারণেই বুঝি রাজধানীতে শীত নামে হেমন্তের শেষে। তামিলনাড়ুতে অকস্মাৎ শুরু হয় ভয়াবহ অকাল বন্যা, যা নাকি গত কয়েক যুগেও হয়নি। ঢাকার আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দক্ষিণের নিম্নচাপ ও বৃষ্টির প্রকোপ কেটে গেলে উত্তরের হিমালয় থেকে শৈত্যপ্রবাহ ধেয়ে আসবে বাংলাদেশের দিকে। ততদিন পর্যন্ত শীতের অপেক্ষা।
অনেকদিন আগে ভাস্কর চক্রবর্তী নামের এক কবি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে লিখেছিলেন, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব...’। শশব্যস্ত নগর জীবনে অবশ্য ঘুমিয়ে থাকা কিংবা অলস সময় কাটানোর অবকাশ নেই। রাজধানীতে প্রতিদিন কেবলই অহর্নিশি ছুটে চলা; প্রতিনিয়ত দিন যাপনের গ্লানি। তবে এর মাঝেও ক্ষণকালের জন্য চোখে পড়ে প্রায় পত্রহীন বৃক্ষ, শোনা যায় ঝরা পাতার গান, রাস্তার পাশে জ্বলন্ত উনুনে পিঠা-পুলির সমারোহ; লেপ-তোশক-কম্বলের সমাহার। এতসব বর্ণিল বিভায় চকিতে প্রতিভাত হয়, শীতের পরপরই বসন্ত বুঝি এলো বলে!
শীর্ষ সংবাদ: