ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ঢাকায় ছাত্রজীবনের আরও কথা (৬ ডিসেম্বরের পর) পাঞ্জাবের দৌলতানা সরকার বরখাস্ত হয় এবং তার জায়গায় মালিক ফিরোজ খান নূন হন মুখ্যমন্ত্রী। কাদিয়ানী দাঙ্গা সম্বন্ধে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান হন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মোঃ মুনীর। কাদিয়ানী দাঙ্গার কারণে মওলানা মওদুদীকে গ্রেফতার করা হয় এবং সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আজম তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে এই ফাঁসির আদেশ মওকুফ করা হয়। কাদিয়ানী দাঙ্গার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলার আইন পরিষদের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দেয়। পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ৯ মে মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলের শুরুতেই নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং কাউন্সিল সেশন বাধাগ্রস্ত হয়। অবশেষে ২৪ আগস্ট কাউন্সিল একটি নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়াস পায়। ঢাকার ফকির আব্দুল মান্নান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক, শাহ আজিজুর রহমান ও মঈনুদ্দিন চৌধুরী হলেন যুগ্ম-সম্পাদক এবং খুলনার আবদুস সবুর খান হলেন জনসংযোগ সম্পাদক। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তার শাসনের দেড় বছর অতিবাহিত হতে না হতেই ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের বড় লাট ধূর্ত গোলাম মোহাম্মদ একান্তই অবৈধভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে এবং আমেরিকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে। গভর্নর জেনারেলের প্রধানমন্ত্রী অপসারণের এই রকম কোন আইনী ক্ষমতা ছিল না। গোলাম মোহাম্মদ যুক্তি দেখায় যে, খাজা নাজিমুদ্দিন অদক্ষ এবং কাদিয়ানী দাঙ্গা দমনে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেরি করেন ও গণপরিষদের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা তার নেই। এই অবৈধ পদক্ষেপ কিন্তু গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম লীগ দল মেনে নিল। তারা মোহাম্মদ আলীকে তাদের নেতা নির্বাচিত করে নাজিমুদ্দিনের নৈতিক শক্তি খর্ব করে দিল। গোলাম মোহাম্মদের স্বৈরাচার, প্রাদেশিকতা, দেশ শত্রুতা এবং দুশ্চরিত্র সম্বন্ধে আরও কিছু লেখার সুযোগ আমার পরবর্তীতে হবে। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন ভারতের হিন্দু মহাসভা দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অত্যন্ত অদ্ভুত একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং ১৯৩৪ সালে অতি অল্প বয়সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। বরং তার পিতা স্যার আশুতোষ মুখার্জীর উদার মানসিকতার উত্তরাধিকারী ছিলেন। তার আর একটি কৃতিত্ব ছিল- তিনি যখন শেরে বাংলা ফজলুল হকের সঙ্গে মিলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন তাদের সময়ে এই প্রদেশে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়নি। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার আব্বার দুই-এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন আমার আব্বা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য। এই বছর আমাদের এলাকায় আর একটি বিশেষ ঘটনা পৃথিবী বিখ্যাত হয়, তা ছিল মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়। নিউজিল্যান্ডের হিলারি এবং নেপালের তেনজিং শেরপা সেই বছর ২৯ জুলাই তারিখে সর্বপ্রথম মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। এই বছরের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়Ñ আমাদের দেশে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রস্তুতি। নানা দলাদলি এবং তর্ক-বিতর্ক সমাধান করে অবশেষে পূর্ববাংলার সকল রাজনৈতিক দল ৪ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় যে, মুসলিম লীগের দুঃশাসনের অবসানের জন্য সকলে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করবে। যুক্তফ্রন্ট ৩০ ডিসেম্বরে তাদের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। ২১ দফা নানাভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ব্যক্তিগতভাবে এই বছর আমার জীবনের একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমার দাদা ৩ জুন ইন্তেকাল করেন। আমি সে সময় কোন ছুটি উপলক্ষে সিলেটে ছিলাম এবং সেদিন দুুপুরেই তাকে দেখতে যাই। দিবানিদ্রা শেষে তিনি তার নির্দিষ্ট আরাম কেদারায় বারান্দায় বসে ছিলেন। তার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়। তখন তিনি প্রায়ই আমার লেখাপড়া নিয়ে আগ্রহ দেখাতেন। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি এবং তিনি তার ছাত্রজীবনের নোট নিয়েও অনেক কথা বলেন। আমাকে তিনি বললেন যে, তার শরীরটা খুব ভাল নয়। তার মনে হচ্ছে যে, তার জ্বর হবে। আমার সঙ্গে একটি ক্যামেরা ছিল। আমি বললাম যে, আপনার একটি ছবি উঠাই। তিনি তার আরাম কেদারায় নড়েচড়ে বসলেন এবং আমি তার ছবি উঠাই। দুর্ভাগ্যবশত ছবিটি সেদিন তুলতে আমি ব্যর্থ হই। আমি সেদিন ফিরে এসে আব্বাকে জানালাম যে, দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তার শরীর খুব ভাল নেই। আব্বা তখনই ঠিক করলেন যে, তিনি তাকে দেখতে যাবেন। কিন্তু তিনি যাবার আগেই খবর এলো যে, দাদা ইন্তেকাল করেছেন। আমার দাদা তার সময়ে বেশ প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন এবং যদিও তিনি সারাজীবন সরকারী চাকরি করেছেন; কিন্তু সিলেট শহর এবং শহরতলীতে বেশ জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। মাসখানেক পর যখন তার চেহলাম হয় তখন সকাল ৯টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সারাদিন সিলেটের লোকজন তার জন্য দোয়া এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। চেহলামের দিনের একটি বিশেষ স্মৃতি হলো যে, আমি তখন ৯ মাস ধরে মুরগি ছাড়া কোন ধরনের গোশত খেতে পারি না। একইভাবে কোন ধরনের ঝাল অথবা হলুদ মসলা খাওয়া বারণ। কিন্তু চেহলামের দিন এসব বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে আমি গরুর তেহারি ও খাসির রেজালা আহার করি এবং সেদিন থেকে আকস্মিকভাবে আমার অসুখ বিদূরিত। বছর শেষে আমি কুমিল্লা গেলাম আমার চাচার বাড়িতে। আমার চাচা তখন কুমিল্লায় সেচ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। সেই বছর কুমিল্লাতে জুলাই-আগস্ট মাসে ব্যাপক বন্যা হয়। বন্যায় কুমিল্লা শহরের বাঁধ অনেক জায়গায় ভেঙ্গে যায়। সেসব বাঁধ রক্ষা কাজে তাকে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থাকতে হয় এবং অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিতে হয়। এ বিষয়ে তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষ মনে করেন যে, তিনি একটু অত্যুৎসাহী ছিলেন। তবে এক ব্যক্তির সহায়তা ও অভিমতের ফলে নিন্দার পরিবর্তে তিনি প্রশংসা লাভ করেন। কুমিল্লা ভ্রমণে সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার পরিচয় হয়। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান। আখতার হামিদ খান বন্যার কয়েক দিনই দিনরাত স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করেন। আমার চাচা এবং তাদের সঙ্গে একযোগে সব ধরনের কাজ করেন। তারা নিজেরাও সে সময় মাটি কাটেন। কুমিল্লা ভ্রমণকালে আর একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন কুমিল্লা মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা উম্মে কুলসুম আয়েশা খাতুন। তিনি ছিলেন মুরারীচাঁদ কলেজের আমার প্রথম অধ্যক্ষ আব্দুর রব চৌধুরী সাহেবের কন্যা। সিলেটের হবিগঞ্জের এই শিক্ষিত পরিবারটির সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অধ্যক্ষ সাহেবের পুত্র লতিফ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। আর এক পুত্র বিচারপতি আব্দুল ওদুদ চৌধুরী ছিলেন আমার আব্বার ভ্রাতুষ্পুত্রসম। আর এক ভাই আব্দুল মতিন চৌধুরী মাস দুয়েকের জন্য আমার কলেজে শিক্ষক ছিলেন। চলবে...
×