ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

তারুণ্যের গল্পগাথায় মহান বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫

তারুণ্যের গল্পগাথায় মহান বিজয়ের মাস

মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর আসন্ন। বিজয়ের ৪৫ বছর আগে এই দিনে ৩০ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রকাশিত হয় রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকার। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের দাবি -এর আগেও যেমন ছিল আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম অবদানের বিন্দু পরিমাণ ঋণ শোধ করার অভিলাষ আজ পাহাড় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের নিঃস্বার্থ আত্মদানের ঋণ কোনভাবেই পরিশোধ করা যায় না। তবে দেশ আজ একাত্তরের পরাজিত শত্রু আর দোসর রাজাকারদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছরে বাঙালী জাতি এই প্রথম একটি অন্যরকম বিজয় দিবস পালন করছে। তরুণ প্রজন্মের নিকট আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রয়াসে জাতির এই অর্জন ইতিহাসের সাক্ষীর মাধ্যমে অম্লান হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমাদের অর্জন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। এরপরও সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্র, যার গতিপথ শুধু এগিয়ে চলার। পাভেল মনজুর আহমেদ তরুণ থিয়েটারকর্মী দিনে দিনে শ্যামল সবুজ সোনার বাংলাদেশে বিজয় দিবস নতুন শপথের স্বপ্ন নিয়ে আসে, মনের অলিন্দে কিছু করার ব্যত্যয় সবার অজান্তে নাড়া দিয়ে যায়। তবু শহীদের বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, মা-বোনের কষ্টের পাহাড় থেকে কিছু বরফ গলিয়ে দেয়ার জন্য অনতিবিলম্বে বাকি সব রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচার করা সময়ের দাবি। সাদিয়া ইউসুফ বৃতা ছাত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাত্তরের বিজয় দিবস ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়। সেই বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাঙালী জাতি তার আত্মমর্যাদা ফিরে পায়। এর ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধে একপক্ষের জয় হয়েছে এবং অন্যপক্ষ পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এ থেকে কি এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে বাংলাদেশ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েছে? তা-ই যদি হবে তাহলে একাত্তর পরবর্তী সময়ে রাজাকার-আলবদররা আজ কেনই বা বুক চেতিয়ে বাংলার বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে? দেশের সব বিশেষ সুবিধা ভোগ করে এসব ঘৃণ্য কীটরা তাদের গাড়িতে কেনই বা বিশেষ পতাকা লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়? তবে আশার বিষয় এই যে, স্বাধীনতার এত বছর পর বাঙালী জাতি কিছু জঘন্য-ঘৃণ্য রাজাকারদের ফাঁসি দিয়ে শুচি হচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের সেই একই ভূমিকায় বাংলা আজ সরব হচ্ছে দিনকে দিন। তাদের জাগরণের জোয়ার আর আন্দোলনেই বিজয়ের কৃতপতাকা আজ পুনরায় উড়ছে উদাত্ত আকাশে। রাশেদ আহমেদ শিপলু তরুণ উদ্যোক্তা তরুণ প্রজন্ম এসেছে পুরাণ থেকে। সেই পুরাণের বিরাট অংশ আছে পৌরাণিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে। তাদের চক্ষু-কর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা, ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা। এসব স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার চরম আদিমতায় বিশ্বাসী। তারুণ্যের জাগরণের আহ্বান তাদের নিকট বিষমাখা ছুরি মনে হয়। কারণ, তারুণ্যই তাদের কাছে বড় বাধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তরুণরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে, রাজাকারমুক্ত করতে, তারাই আবার বিজয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর পরে উত্তাল হয়ে উঠছে রাজাকারমুক্ত করে পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য করার দৃপ্ত শপথে। আমাদের স্বাধীনতা তারুণ্যের বিজয়েরই বাস্তব রূপ ছিল। বিজয়ের এত বছর পরেও এই সময়ে বাংলার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠা পাকিস্তানী এজেন্ট ও স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ নতুনেরে জাগরণকে চক্রান্ত দিয়ে চুপ করে রাখতে চায়। কিন্তু আর নয় এই প্রহসন! আজ আর দেশদ্রোহী, রাজাকারদের ঠাঁই নেই বাংলার মাটিতে। একে একে এই স্বাধীনতাবিরোধী দোসরদের চিহ্ন বিলুপ্ত হওয়ার পথে এবং সেটা তারুণ্যের হাত ধরেই হবে। রোমানা শাওন সমাজকর্মী ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’Ñ বাঙালীর জন্য এই বাক্যটি যেন চরম সত্য। আমার মনে হয়, বাংলা ভাষায় নির্ভীক কণ্ঠে প্রথমে স্বাধীনতার জয়গান করেন তারুণ্যের প্রতীক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বেঁচে থাকতে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ নেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে এসে দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল একটা বোধ থেকেই। বাংলা ভাষায় স্বাধীনতার কথা নানাভাবে গাওয়া হয়েছে আগে এবং বর্তমান সময়ে। ১৯৭১ সালে যখন রাজনীতিকরা ছয় দফা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা নিয়ে আলোচনা করছেন, তখন পদ্মা-মেঘনা-যমুনাপারের তরুণেরা বলেছিল, ছয় দফা নয়, এক দফা এবং রণধ্বনি তুলেছিলÑ বীরবাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ‘আর এখন তরুণেরা সামনে থেকে যে কোন অরাজকতার বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলছে। সেটা গণজাগরণ মঞ্চ থেকেই হোক কিংবা কোন বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। সেই যুদ্ধে যারা মারা যান, তারা বড় স্বপ্ন নিয়ে মারা যান। যারা বেঁচে থাকেন, তারা বড় স্বপ্ন লালন করতে থাকেন। তাদের সেই স্বপ্ন যেমন অনেকখানি সার্থক হয়েছে, তেমনি অনেকখানি ব্যাহতও হয়েছে। কিন্তু সেই অঙ্গীকারের কিছুটা হলেও প্রতিফলন হয়েছে রাজাকারদের ফাঁসির মাধ্যমে। বাংলা আর বাঙালী যেন আজ মুক্ত আকাশের পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করছে। জাতি হিসেবে আজ আমরা কিছুটা হলেও সফল বলে আশা করতে পারি। সঞ্জয় নীল তরুণ লেখক ছোটবেলা থেকে একটা কথা শুনে বড় হয়েছি ‘স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।’ আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা আর আমার মা কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধা না হলেও আমার কাছে তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে একচুল পরিমাণ কম নন। কিন্তু তাদের মুখ থেকে শোনা সেই সময়ের কথা আর আজকের বর্তমান বাস্তবতা দেখলে কেমন জানি নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। যদি প্রশ্ন করা হয় কেন? উত্তরে বলব, ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত আর হাজারো মানুষের ঘর উজাড় করে যে স্বাধীনতা তাঁরা আমাদের এনে দিয়েছিল, তা কি আমরা আদৌ রক্ষা করতে পারছি? যখন কিছু স্বাধীনতাবিরোধী মানুষের কারণে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত হয়, দিনেদুপুরে মানুষ লাশ হয়ে পড়ে থাকে কোলাহলে তখন আমি সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ হই, আদৌ আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে পারছি কিনা!
×