ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দমকল কর্মীদের কয়েক ঘণ্টা অভিযানের পর বুড়িগঙ্গা তীর থেকে লাশ উদ্ধার

এবার খোলা স্যুয়ারেজ লাইনের বলি ৫ বছরের নীরব

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

এবার খোলা স্যুয়ারেজ লাইনের বলি ৫ বছরের নীরব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রায় এক বছর আগে ওয়াসার পানির পাম্পের পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর আলোচিত ঘটনার পর আবারও রাজধানীর কদমতলীতে একইভাবে ওয়াসার স্যুয়ারেজ পাইপে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে পাঁচ বছর বয়সী শিশু নীরবের। একমাত্র সন্তানকে ভাল শিক্ষা দিয়ে আর মানুষের মত মানুষ করা হলো না। কাকতালীয় হলেও সত্য, জিহাদের মত নীরবও ডিসেম্বর মাসেই খেলতে গিয়ে প্রায় একই সময়ে ওয়াসার পাইপেই পড়ে যায়। জিহাদের লাশ ২৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার হয়েছিল। আর নীরবের লাশ উদ্ধার হলো চার ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার ভাটিতে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নীরবের মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আছে। শত শত মানুষ ভিড় করছেন বাড়িটিতে। সবার মুখে একই আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরছেন। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণকারী ঠিকাদারকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। লাইন তৈরির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন শ্যামপুরের নতুন কদমতলী এলাকার পালপাড়ায় ঘটনাটি ঘটে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে পালপাড়া। নীরবের পিতা রেজাউল করিম। আরএফএল কোম্পানিতে কর্মরত। একমাত্র পুত্র নীরব আর স্ত্রী নাজমা বেগম (২৭)। মাসিক ৩ হাজার টাকায় সুরুজ মিয়ার ৭৮ নম্বর একতলা টিনশেড বাড়ির একটি কক্ষে ভাড়ায় বসবাস করেন। তাও প্রায় ২ বছর ধরে। বাড়ির সামনেই রেললাইন। সেই লাইন ঘেঁষা ছোট্ট খালের পাড়ে ত্রিভুজ আকৃতি একটি খেলার মাঠ। তাতেই পাড়ার সব ছেলেমেয়ে বিকেল হলেই নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠে। সেখানে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন রয়েছে। নতুন তৈরি করা লাইনের পর পর দুইটি চৌবাচ্চা রয়েছে। তার একটি পুরোপুরি সিমেন্টের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। আরেকটি অর্ধেক ঢাকা। প্রায় পাঁচ ফুট পাটাতনের আড়াই ফুট সিমেন্টের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। বাকিটুকু ফাঁকা। পিতা কর্মের তাগিদে বাইরে। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে সমবয়সী হৃদয় ও রাতুলের সঙ্গে সেই মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিল। দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে স্যুয়ারেজের ওই ফাঁকা অংশ দিয়ে পড়ে যায় নীরব। সঙ্গে সঙ্গে খেলার সাথীরা বিষয়টি সেখানে থাকা লোকজনকে জানায়। লোকজন স্যুয়ারেজ লাইনের কাছে যেতে যেতেই প্রচ- গতিতে যাওয়া বর্জ্য পানি নীরবকে টেনে নিয়ে যায় স্যুয়ারেজ লাইনের ভেতরে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি দল ও পুলিশ উদ্ধার অভিযানে নামে। তারা ভাটির দিকে অন্তত ১০টি স্যুয়ারেজ লাইনের ইস্পাতের পাটাতন গ্যাস কাটার দিয়ে দ্রুত কেটে নীরবকে সার্চ লাইট দিয়ে খুঁজেছেন। শ্যামপুর স্ট্যান্ডের চালক মজিবুর রহমান বলছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছে তা বলার মতো নয়। ১০টি ঢাকনা তারা একসঙ্গে কেটে নীরবকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্যুয়ারেজ লাইনের পানির গতি মারাত্মক বেশি থাকায় নীরবকে উদ্ধার করা যায়নি। কারণ নীরব সে স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মৃত অবস্থায় পড়েছে। সেখান দিয়ে কদমতলী এলাকার সব কারখানার বর্র্জ্য ও পানি বের হয়। তিনি আরও জানান, নীরব স্যুয়ারেজ পানির লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ে। তখন সন্ধ্যা আনুমানিক ছয়টা। সেই স্যুয়ারেজ লাইনের পাশেই একজন বৃদ্ধ মাছ শিকারের জন্য বড়শি ফেলেছিলেন। আচমকা একটি শিশুর মরদেহ স্যুয়ারেজের লাইন দিয়ে তিনি পড়তে দেখেন। এরপর তিনি নামতে যান। এ সময় পানির তোড়ে নীরব আবার ডুবে যায়। আর নীরবকে দেখা যাচ্ছিল না। তার কথায় সবাই সেই স্যুয়ারেজ লাইনের কাছে গিয়ে হাজির হন। তৎক্ষণাৎ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সেখানে নীরবকে খুঁজতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত রাত আটটার পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা নীরবকে সেখানে থাকা বালু উত্তোলনের ড্রেজারের পাখার সঙ্গে আটকে থাকা অবস্থায় উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। আজ সুরতহাল শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের কথা রয়েছে। নীরবকে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানাধীন পুরঘাটা এলাকার পশ্চিম বেনুগ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা রয়েছে। কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, এ ব্যাপারে পরিবারের তরফ থেকে মামলা দায়ের করার কথা। তা না হলে পুলিশের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হবে। স্যুয়ারেজ লাইনটি তৈরির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। ঢাকনা না থাকার কারণ সম্পর্কেও তদন্ত চলছে। সোমবার রাত একটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভজন কুমার সরকার জনকণ্ঠকে জানান, স্যুয়ারেজ লাইনটির গভীরতা ৬-৭ ফুট। তবে ভেতরে প্রচ- গতিতে পানি প্রবহমান থাকায় সেখানে কারও পক্ষেই উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়। আর প্রচ- গতির স্রোত দ্রুত নীরবকে টেনে নিয়ে যায়। এমন ঘটনার পর শত শত মানুষ ভিড় করে সেই স্যুয়ারেজ লাইনের কাছে ও নীরবের পরিবারে। আর হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে বুড়িগঙ্গা থেকে নীরবের লাশ উদ্ধারের সময়। যেখান থেকে নীরবের লাশটি উদ্ধার হয়, সেখানে বিকট শব্দে প্রচ- গতিতে পানি পড়তে দেখা গেছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানাধীন রেলওয়ে কলোনির বালুরমাঠ সংলগ্ন এলাকায় খেলতে গিয়ে ওয়াসার পরিত্যক্ত পানির পাম্পে পড়ে যায় ৪ বছরের ছোট্ট শিশু জিহাদ। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। জিহাদ উদ্ধার নিয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম হয়। কেউ কেউ বলেন, পাইপে কোন শিশুর অস্তিত্ব নেই। এমন কথাবার্তার পর নানা গুজব ডালপালা মেলতে থাকে। জিহাদের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে পুলিশ জিহাদের পিতাকে শাহজাহানপুর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। টানা ২৩ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয় ফায়ার সার্ভিস। ভেতরে কোন লাশের অস্তিত্ব না থাকার তথ্য জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। উদ্ধার কাজ সাময়িক বন্ধ ঘোষণার আধঘণ্টা পরেই স্বেচ্ছাসেবী ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা ক্যাচার বক্সের মাধ্যমে জিহাদের লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এরপরই দেশব্যাপী নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনায় জিহাদের পিতা নতুন পাম্প স্থাপনকারী এসআর হাউজের স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম ও রেলওয়ের সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া জ্যেষ্ঠ উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিদের গাফিলতির কারণেই তার ছেলে পাইপের পড়ে গিয়ে মারা গেছে। পাইপের মুখে ঢাকনা লাগানো থাকলে এ দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। এ ঘটনায় উচ্চ আদালত জিহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার নির্দেশ দেন।
×