ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস পালন শুরু

একাত্তরের বিপুল ক্ষতি দগদগে ক্ষত, বিশ্বে তুলে ধরার সুযোগ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

একাত্তরের বিপুল ক্ষতি দগদগে ক্ষত, বিশ্বে তুলে ধরার সুযোগ

মোরসালিন মিজান ॥ কিছু মানুষ মানুষের চেহারা নিয়ে জন্মায় কেবল। আদতে দানব। হিংস্র হায়েনা। যুগে যুগে এরা মানুষের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। মানুষ হয়ে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয়েছে ভয়ঙ্কর জেনোসাইড বা গণহত্যা। বর্তমান পৃথিবীও খুব বেশি নিরাপদ নয়। সামনে যতটুকু দেখা যায়, বিপদশঙ্কুল। এই বাস্তবতায় আজ ৯ ডিসেম্বর বুধবার সারাবিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হবে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস। চলতি বছর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বিগত দিনে সংঘটিত গণহত্যার নির্মম নিষ্ঠুর ইতিহাস স্মরণ করা হবে। সেইসঙ্গে শপথ নেয়া হবে গণহত্যা বন্ধের। আর প্রসঙ্গ যখন গণহত্যা, বাংলাদেশ তখন অনিবার্য আলোচনা। ১৯৭১ সালে এই ভূখ-ে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। এক নদী রক্তে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ জেনোসাইড বা গণহত্যার নির্মম সাক্ষী। বিপুল ক্ষতি, দগদগে ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। বাঙালীর চেয়ে বেশি আর কে জানবে স্বজন হারানোর ব্যথা? দিবসটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বাংলাদেশ আজ স্মরণ করবে একাত্তরের শহীদদের। সে লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী। শুধু দেশে নয়, গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসের আলোচনায় সারাবিশ্বেই সামনে থাকবে বাংলাদেশ। এর ফলে একাত্তরের নির্মমতার ইতিহাস তুলে ধরার নতুন সুযোগ হলো। তেমনই মানুষের পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। জেনোসাইড বা গণহত্যা কথার অর্থ অনেক ব্যাপক। কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সমূলে ধ্বংস করার জন্য পরিচালিত নারকীয় অপরাধের স্বরূপ তুলে ধরতে জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করা হয়। গ্রিক শব্দ ‘জোনো’ এবং ল্যাটিন শব্দ ‘সাইড’ একত্রিত করে জোনোসাইড শব্দটি পাওয়া যায়। ‘জোনো’ অর্থ গোত্র বা সম্প্রদায়। ‘সাইড’ অর্থ হত্যা। অর্থাৎ, জাতি গোষ্ঠীর জীবনধারার প্রয়োজনীয় মূল ভিত্তি ধ্বংস এবং সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করার জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের একটি সমন্বিত পরিকল্পনার নাম জেনোসাইড বা গণহত্যা। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয়েছে নারকীয় হত্যাকা-। ১৯৪১-১৯৪২ সালে গণহত্যার শিকার হয় সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীরা। ১৯৪৪ সালে সংঘটিত হয় রুয়ান্ডার গণহত্যা। ১৯৩৩-৪৫ সালে সংঘটিত হয় ইহুদী হলোকাস্ট। জানা যায়, ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে জার্মান নাজিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদীকে। ইতিহাসে এই হত্যাকা- হলোকাস্ট নামে পরিচিত। ১৯৪৪ সালে র‌্যাফায়েল লেমকিন নামের এক পোলিশ ইহুদী আইনজীবী ইউরোপীয় ইহুদী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নাজিদের সুপরিকল্পিত ও সুপরিচালিত হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেন। এ হত্যাকা-ের ব্যাপকতা বোঝাতে প্রথমবারের মতো জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরে হলোকাস্টের পটভূমি বিবেচনায় রেখে লেমকিনের নিরন্তর প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ অনুমোদন করে ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’। এই কনভেনশনের মাধমে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, জেনোসাইড একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। জেনোসাইডকে সংজ্ঞায়িত করে এখানে বলা হয়েছেÑ কোন একটি জাতি, উপজাতি, গোত্র বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিচের যে কোন কাজ সম্পাদন করা। যেমনÑ কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা। কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন করা। ইচ্ছাপূর্বক কোন গোষ্ঠীর জীবনধারাকে পরিকল্পিতভাবে প্রভাবিক করে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করা। কোন গোষ্ঠীর ওপরে জোর করে জন্মনিরোধ চাপিয়ে দেয়া এবং জোর করে এক গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর কাজে হস্তান্তর করা। আর তার পর চলতি বছর আরও একধাপ এগিয়ে এসে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় জরুরী এই সিদ্ধান্ত। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জেনেভায় জেনোসাইড কনভেনসন গৃহীত হয়। এ তারিখটিকেই বেছে নেয়া হয় আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। একইসঙ্গে ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের মাস। বিজয়ের মাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী শক্তিকে ধ্বংসের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-ের মাধ্যমে লাখ লাখ বাঙালীকে হত্যা করে। ডিসেম্বরে স্বজন হারানোর ব্যথাটা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। ফলে দিবসটির সঙ্গে খুব সহজেই যুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, এ ধরনের একটি দিবসের দাবি অনেকদিন ধরেই করা হচ্ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তোলা হচ্ছিল দাবিটি। বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর বলা হয়েছে। এবার বাস্তব রূপ পেল। আজকের অশান্ত পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের বিগত অতীত থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। গণহত্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হবে। আর তাহলে প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখা যাবে। বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্ব সচেতন করতেই নতুন দিবস। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দিবসটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। বলেন, দিবসটি ঘিরে আমাদের তো অনেক কথা বলার আছে। করার আছে। গণহত্যার কারণগুলো আমরা আরও যাচাই করে দেখতে পারব। তাছাড়া, ডিসেম্বর এমনিতেই বাঙালীর আবেগের মাস। স্মৃতির মাস। স্মৃতিগুলো আন্তর্জাতিক দিবসটির সঙ্গে যুক্ত হবে। আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই বিচারের যৌক্তিকতা এখন গ্লোবালি আরও সুন্দরভাবে তোলা যাবে। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে গণহত্যা বন্ধে ভূমিকা রাখার জন্য সরকারসহ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। অবশ্য প্রথমবার হলেও, এরই মাঝে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আজ থাকছে দিনব্যাপী আয়োজন। বিকেলে জাদুঘর প্রাঙ্গণে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হবে। মঞ্চে থাকবে আলোচনা, গণহত্যা বিষয়ক রচনা থেকে পাঠ ও নাট্য প্রদর্শনীর আয়োজন।
×