আজাদ সুলায়মান ॥ শাহজাহানপুরে ওয়াসার তিন শ’ ফুট গভীর পাইপে পড়ে পাঁচ বছরের শিশু জিহাদের করুণ মৃত্যুর ঘটনায় তখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলে। হৃদয়বিদারক ওই দৃশ্য যারাই দেখেছেন তারা এর দায় চাপিয়েছেন ঠিকাদারের ওপর। এতে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয়ার পরও হুঁশ হয়নি কোন মহলেরই। ওয়াসা, ডেসা, টিএ্যান্ডটি, সিটি কর্পোরেশন কিংবা অন্য কোন সংস্থাই শিক্ষা নেয়নি, যে জন্য এক বছরের মাথায় এ ধরনের আরও একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে নীরবের মতো পাঁচ বছরের নিষ্পাপ শিশু। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর শ্যামপুরের খোলা ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টার মাথায়ই তার করুণ মৃত্যু ঘটে। চার ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে বুড়িগঙ্গার সøুইসগেট থেকে।
এ ঘটনায় বিস্মিত প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রশ্ন, যে কায়দায় জিহাদ গেল, শিহাব গেল, নীরব গেলÑ এরপর কার পালা? শ্যামপুরেই এ ধরনের আরও অনেক খোলা নালা ও ম্যানহোল রয়েছে। রাজধানীজুড়ে রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য মৃত্যুফাঁদ। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রতিকার মিলছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির খেসারত দিতে হচ্ছে নিরীহ নগরবাসীকে। জিহাদ, শিহাব ও নীরবের মতো নিষ্পাপ শিশুদের। ঢাকনাবিহীন এসব ম্যানহোল, স্যুয়ারেজ, গর্ত, নালা ও পাইপ শিশুদের জন্য ভয়ঙ্কর এক মরণফাঁদ।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, রাজধানীতে এ ধরনের অন্তত অর্ধশতাধিক ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল ও খোলা নালা রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন সংস্থার। অবশ্য সব স্যুয়ারেজের দায়-দায়িত্ব ওয়াসার।
শ্যামপুরের যে নালায় পড়ে শিশু নীরবের মৃত্যু ঘটে সেটা একটি শিল্প-কারখানার। ওই কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা এ নালা দিয়ে অনবরত প্রবল বেগে বর্জ্য নামে বুড়িগঙ্গায়। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভারও ওই কারখানার মালিকপক্ষের। এ ঘটনায় ওই মহল্লায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
প্রতিবেশীদের অভিযোগ, বার বার নালিশ করার পরও নালামুখের ঢাকনা লাগানো হয়নি। যদি ঢাকনা থাকত তাহলে নীরবের এমন করুণ পরিণতি দেখতে হতো না। অভিশপ্ত এ নালা (স্যুয়ারেজ) শুধু যে নীরবেরই প্রাণ কেড়েছে তা নয়। এর আগে শিহাব নামে আরও এক শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছে।
শ্যামপুরে বরইতলা জাগরণী মাঠের পশ্চিম দিকের পালপাড়া রোডে যে স্যুয়ারেজলাইনে শিশু নীরব পড়ে যায়, বছর চারেক আগে সেখানেই পড়ে প্রাণ গেছে শিশু শিহাবের। তারও বয়স ছিল পাঁচ বছর।
নীরবকে উদ্ধারের অভিযানের মধ্যেই নিজের ছেলে হারানোর এ কথা জানিয়েছেন শিহাবের মা শিরিন। শিরিনের অভিযোগ, চার বছর আগে এই স্যুয়ারেজলাইনে পড়ে তার ছেলে নিহত হলেও দুর্ঘটনা রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শিহাবের ঘটনার বিষয়ে তিনি আরও জানান, শিহাব পড়েছিল দুপুর বারোটার দিকে। বিকেল তিনটার দিকে স্থানীয়রা তার মরদেহ উদ্ধার করে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পালপাড়া রোডের ঠিক এই এলাকাটিতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। গত সোমবারও এক বৃদ্ধ পড়ে গেলে তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে।
ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকেল থেকেই নীরবের পরিবারে শুরু হয় গগনবিদারী কান্না। বুধবারও থামেনি সেই কান্না। শোকে পাথর হওয়া নীরবের মা নাজমা বেগম বার বার বুক চাপড়াচ্ছিলেন আর বলছিলেন, কার দোষে বুকের ধন হারালাম। কারা দায়ী? ওখানে একটা ঢাকনা থাকলেই নীরব মরত না। এটা কার দোষ?
গত বছর নাজমা টিভিতে জিহাদের ঘটনা দেখে নিজের বুকের ধন নীরবকে নিয়ে ভয়ে ছিলেন। নীরবও টিভিতে সে দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছিল। তখন ভয়মিশ্রিত আদরের সুরে নীরবকে সতর্ক করেছিলেন- ‘মাকে না বলে কখনও খেলতে যেও না। তাহলে জিহাদের মতো মরে যাবে।’
এ ধরনের মরণফাঁদের বিষয়ে নীরবের শোকার্ত পিতা বলেন, শ্যামপুর এলাকায় এ ধরনের অনেক খোলা ম্যানহোল রয়েছে। সেগুলোর ওপর সরকারী নজরদারি করতে হবে। আমি সরকারের কাছে আবেদন করি, ওই এলাকার সকল খোলা ম্যানহোলের প্রতি যেন তারা দৃষ্টি দেয়।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে মাঠসংলগ্ন পরিত্যক্ত পানির পাম্পের ৩শ’ ফুট গভীর পাইপে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। ২৩ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার পর শিশু জিহাদকে মৃত অবস্থায় ওয়াসার গভীর নলকূপের পাইপ থেকে বের করে আনে স্বেচ্ছাসেবী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারক্ষমতাও প্রশ্নের মুখে পড়ে।
এদিকে শ্যামপুর ছাড়া রাজধানীর নাখালপাড়া, বেগুনবাড়ি, তেজগাঁও সেগুনবাগিচা, রামপুরা, সায়েদাবাদ, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, সোয়ারিঘাট, বুড়িগঙ্গার দুই তীর, মিরপুর, আগারগাঁও এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল রয়েছে। এসব ম্যানহোলে যে কোন সময় অন্য শিশুদেরও করুণ পরিণতি ঘটার চরম আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়াসা সূত্র জানায়, ম্যানহোলের ঢাকনা এক সময় ছিল দামী ইস্পাতের। রাতের আঁধারে এসব চুরি করে নিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে। এ ধরনের কিছু ম্যানহোলের ঢাকনা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিছু বাকি রয়েছে। যেগুলো এখনো লাাগনো সম্ভব হয়নি সেগুলোতে বাঁশ কিংবা খুঁটি দিয়ে পথচারীদের সতর্ক করা হচ্ছে। অচিরেই সেগুলোতে ঢাকনা লাগানো হবে।
শাহজাহানপুরে গভীর পাইপে পড়ে শিশু জিহাদ মারা যাওয়ার পর তার বাবা নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শাহজাহানপুর থানার এসআই আবু জাফর দু’জনকে অভিযুক্ত করে ৩০৪ ধারায় একটি চার্জশীট দাখিল করেন। এতে অভিযুক্ত করা হয় রেলওয়ের প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম ও ঠিকাদার আবদুস সালাম শফিককে। কিন্তু বাদী তাতে নারাজি দিয়ে আরও চারজনকে আসামি করার আবেদন জানান। তারপর থেকে মামলাটি এখন ডিবিতে। ডিবি বার বার বলছে, অধিকতর তদন্তের জন্য সময় লাগছে। ডিবির এই অধিকতর তদন্ত আর শেষ হচ্ছে না। এজন্য আদালতে প্রতিবেদনও দাখিল করতে পারছে না।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিদের গাফিলতির কারণেই তার ছেলে জিহাদ পাইপে পড়ে মারা গেছে। পাইপের মুখে ঢাকনা লাগানো থাকলে এ দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। তার ছেলেকে হয়ত এভাবে মরতে হতো না। এ ঘটনায় উচ্চ আদালত জিহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার নির্দেশ দেয়।