ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর প্রতি সহিংসতা

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

নারীর প্রতি সহিংসতা

উদ্যোগটি যে অভিনব, সে বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। রাজধানীতে ১৬ দিনব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত ৯টি দেশের নারী রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা সম্মিলিতভাবে এক নিবন্ধ লিখেছেন, যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে। অবশ্য এর একটা পটভূমি আছে। প্রতিবছর ২৫ নবেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবসে ১৬ দিনের কর্মতৎপরতা শুরু হয় এবং সেটি শেষ হয় ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে। জাতিসংঘের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রচারাভিযানে নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে সরকারী কর্মকর্তা এবং কমিউনিটি নেতাসহ সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভুটান, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা লিখেছেন নিবন্ধটি। স্বল্প সম্পাদকীয় পরিসরে নিবন্ধটি নিয়ে বিস্তারিত বলার কোন অবকাশ নেই। তারা যা বলেছেন সংক্ষেপে তা হলো, নারীর প্রতি সহিংসতা সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্য হুমকিস্বরূপ। সে অবস্থায় নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দ্রুত সাড়া দিতে হবে সবাইকে। বাস্তবতা হলো, নারীর প্রতি সহিংসতা শুধুু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। যদি কেউ বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর প্রতি কোন সহিংসতা হয় না, তাহলে ভুল বলা হবে। তবে সহিংসতার মাত্রা কোথাও কম, কোথাও বেশি এই যা। গবেষণালব্ধ তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনের একজন নারী তার জীবনে সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ৮৭ ভাগ বিবাহিত নারী তাদের স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন। এর বাইরেও রয়েছে বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, যৌতুকের কারণে হামলা-মামলা-হত্যা-নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারী-পুরুষ বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয়, সামজিক ও পারিবারিক বৈষম্য, অসম আচরণ ইত্যাদি। বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন মাত্রার নারী নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশে যেন নারী নিগ্রহের আদিঅন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং বলা যায়, এখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীর প্রতি অবিচার, অনাচার, শোষণ ও বঞ্চনা বিরাজমান। এর মূল কারণ অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, সর্বোপরি কুসংস্কার ও কূপম-ূকতা। সত্য বটে, এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী উন্নœয়নের পথে অনেকটা এগিয়েছে, অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পীকার, সর্বোচ্চ আদালত এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারী ক্ষমতাসীন। শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ কয়েকটি সামাজিক সূচকেও নারীর অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। এরপরও দেখা যায় কোথাও না কোথাও গলদ রয়ে গেছে। ক্ষমতার বিভিন্ন সেক্টরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতা, নারীর প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভাব। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের যে ধরনের প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে তাতেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রতীক হিসেবে চুড়ি, চকোলেট, পুতুল, ফ্রক, কাঁচি, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি কোন্্ ধরনের মনমানসিকতার পরিচয় বহন করে তা সহজেই অনুমেয়। এর আগেও নির্বাচন কমিশন নারীর প্রতি অবমাননাকর প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা এবং প্রতিবাদও হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিজেদের সংশোধনের আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু হ্যাঁ হতোস্মি। অনেকটা এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের অনুধাবন করতে হবে ঢাকাস্থ নয় রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের লিখিত নিবন্ধের সারসংক্ষেপটি। বদলাতে হবে নিজেকে ভেতর থেকে এবং কাজ করতে হবে সবাইকে একযোগে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে।
×