ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

আর মাত্র কয়েকটা দিন। তার পর ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিজয় অর্জন করেছিল বাঙালী। নয় মাস বাংলার সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্ব প্রদর্শন করে, তাতে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী বাহিনী। দিবসটি ঘিরে তাই ভীষণ অহঙ্কার বাঙালীর। যারপরনাই আবেগ। প্রতি বছরই ব্যাপক আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। রাজধানী ঢাকায় এখন চলছে সেই প্রস্তুতি পর্ব। ব্যস্ত রাস্তায়, গলির মুখে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে জাতীয় পতাকা। লাল সবুজের পতাকা দেখে মন ভরে যায়। কেমন যেন দোলা দেয় ভেতরে। সাধারণ সময়ে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের যে আইন, মান্য করেন সবাই। বিজয়ের মাসে তা নয়। পূর্বপুরুষের সাহসিকতার স্মারক হাতে নিয়ে যে যেমন পারেন বেরিয়ে যান। শিশু-কিশোরদের তো পতাকা দেখামাত্রই কিনে দিতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়িতে এমনকি পাবলিক বাসে ইতোমধ্যে উড়ানো শুরু হয়ে গেছে প্রিয় পতাকা। দেখে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক মুহূর্তটির আর দেরি নেই। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় কান পাতলেও শোনা যায় একাত্তরের সুর। এখানে ওখানে বাজছে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। বৃহস্পতিবার কাকরাইল মোড় দিয়ে আসার সময় মাইকে বাজছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কালজয়ী রচনাÑ আমরা হারবো না হারবো না/তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না/আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাঁটি গড়তে জানি/তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি...। গানটি শুনতে শুনতে কখন যেন চলে যাওয়া হয় একাত্তরে। আজকের দিনেও একইভাবে বুকে সাহস যোগায় স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। জানিয়ে দেয় নতুন করে শপথ নেয়ার দিন আসছে। আসছে ১৬ ডিসেম্বর। আনন্দের মাস হলেও মঙ্গলবার বেদনায় ডুবেছিল ঢাকাবাসী। এদিন কদমতলীতে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনে পড়ে গিয়ে করুণ মৃত্যু হয় শিশু নীরবের। গত বছর প্রায় একই সময় শহজাহানপুরে খেলতে গিয়ে ওয়াসার পাইপের হা করে থাকা মুখ দিয়ে জীবনের ওপারে চলে যায় শিশু জিহাদ। শিশুটির মৃত্যু গোটা শহরকে বিষণœ করে। অপরাধী করে। তারপর নীরব। পাঁচ বছরের বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয় সুদূর বুড়িগঙ্গা থেকে। ততক্ষণে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এইটুকুন শিশু মায়ের কুলে ফিরেছে লাশ হয়ে! মা তাই দিশেহারা। বুড়িগঙ্গার সব জল যেন তাঁর চোখে আছড়ে পরে। টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার কান্নাকে ছড়িয়ে দেয়। রাজধানীর মানবিক মানুষ স্থির থাকতে পারেননি। কেঁদেছেন তারাও। কিন্তু এই কান্নার শেষ কোথায়? আর কত প্রাণ গেলে ঢাকার ম্যানহোলগুলোর মুখ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হবে? স্যুয়ারেজ লাইনগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে থাকবে আর কতদিন? প্রশ্নগুলো এখন তোলা হচ্ছে। ঘটনার পর রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ লাইনের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। এক জায়গায় ঠিক তো, দশ জায়গায় মুখ হা করে আছে। ঢাকনাবিহীন এসব ম্যানহোল, সুয়ারেজ, গর্ত, নালা ও পাইপ রাজধানীবাসীর জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ফেসবুকের কথাও একটু বলা চাই। সামাজিক যোগাযোগের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মাধ্যম হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, ফেসবুক ব্যবহার করেন সব বয়সী মানুষ। সারা দুনিয়ার সঙ্গে এই মাধ্যমে চলে যোগাযোগ। অভিযোগ আছে, ফেসবুক ব্যবহার করে চলে জঙ্গী তৎপরতাও। সরকার তাই বিশেষ নজর দেয় এদিকে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের রিভিউ আবেদন হাইকোর্টে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়া হয় ফেসবুক। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। সাময়িক নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয় অধিকাংশ ব্যবহারকারী। কিন্তু ১৮ নবেম্বর বন্ধ হওয়ার পর আর তা খোলার নাম নেই। তাতেই শুরু হয় প্রতিক্রিয়া। ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগানে দেশ যে যথেষ্টই এগিয়েছে, তার প্রমাণ ফেসবুক বন্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলো। বিকল্প পথে লগইন করে অনেকেই স্থায়ীভাবে ফেসবুক বন্ধের আশঙ্কা করেন। এটি খুলে রাখার যুক্তি তুলে ধরেন। একজন ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়া এরকমÑ ফেসবুকে স্বাধীন চিন্তার প্রগতিশীল মানুষ তাদের মতপ্রকাশ করেন। তেমনি দেশবিরোধী রাজাকার মৌলবাদী ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠী তাদের অপপ্রচার চালায়। দুটো মত-পথের অনিবার্য সংঘাত কিছু সত্য প্রতিষ্ঠা করে। কিছুটা হলেও করে। সেই অর্জনকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাছাড়া একেবারে সাধারণ মানুষটি যে ভাবনার কথা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার দারুণ ক্ষমতা পেয়েছিল, সেটি রহিত করে তাকে ক্ষমতাহীন করা হচ্ছে। আরেকজন প্রশ্ন তুলেনÑ টেলিভিশনের টকশোতে বার বার দেখা মুখগুলো যেসব বস্তাপঁচা কথা বলে, তার থেকে অনেক বেশি নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে, দেখার চোখ নিয়ে অন্ধের জীবন বোবার জীবন কাটাবে কেন আজকের প্রজন্ম? তার মৌলিক চিন্তা বিকাশের জনপ্রিয় পথটি কেন বন্ধ করে দিতে হবে? ফেসবুকটাকে কিছু লোক ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছে। তার মানে কি এই যে, ফেসবুক বন্ধ করে দিলে জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে? অসংখ্যা যোগাযোগ মাধ্যমের এটি একটি মাত্র। আর ফেসবুক তো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভবও নয়। যারা ভুল কাজে ব্যবহার করে তাদের কৌশলই আলাদা। তার পরও সব দোষ ফেসবুককে দেয়ার মধ্য দিয়ে এক ধরনের শিশুতোষ ভাবনার প্রমাণ দেয়া হচ্ছে। কেন? এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পর বৃহস্পতিবার খুলে দেয়া হয় ফেসবুক। ২২ দিন পর আবার অনলাইনে বসে মিলনমেলা। আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে শহর ঢাকার সর্বত্র। সন্ধ্যায় টিএসসিতে গিয়ে দেখা যায়, সেই চেনা দৃশ্য। ছেলেমেয়েরা মাথা নিচু করে ফেসবুকে ডুব দিয়েছে। বিনা খরচের ওয়াইফাই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলছে হুলুস্থুল আড্ডা।
×