ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাহসী নারী

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধে সাহসী নারী

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ ও বাঙালীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । এর মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতি দেখেছিল তার শ্রেষ্ঠ স্বপ্নটি, রচনা করেছিল তাদের শ্রেষ্ঠ আখ্যান। হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে তারা হতে পেরেছিল শ্রেষ্ঠ বাঙালী। তবে ইতিহাস সাক্ষী, মুক্তিযুদ্ধে বা স্বাধীনতা অর্জনে নারীর ভূমিকা এবং ত্যাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধ মানে আগুন, যুদ্ধ মানে নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে পলায়নÑ যুদ্ধ মানে ঘরবাড়ি প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-শত্রুর নির্যাতন অত্যাচার। আর যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরাই। মা, স্ত্রী বা বোন হিসেবে প্রিয়জনকে হারানো এবং নিজের সম্ভ্রম হারানো। এদেশের নারীরা যুগে যুগে জাতির যে কোন ক্রান্তিলগ্নে যেমন এগিয়ে এসেছে, মুক্তিযুদ্ধেও এগিয়ে এসেছেন একইভাবেÑ যুদ্ধ প্রস্তুতিকাল থেকে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নারীর জীবনে সবচেয়ে বেশি নেমে এসেছে দুর্যোগ। মুক্তিযুদ্ধে নারী যেমন অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে লড়েছেনÑ তেমনি যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, গোপনে অস্ত্র ও তথ্য সরবরাহ করেছেন জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। বরিশালের মেয়ে ১৯ বছরের করুণা বেগম। তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল হাসানসহ আরও তিনজনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। প্রতিশোধের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় করুণা বেগম তাঁর একমাত্র ছেলেকে শাশুড়ির কাছে রেখে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধার ট্রেনিং নিলেনÑ চুল কেটে পুরুষের ছদ্মবেশেÑ ‘গোপন জায়গা থেকে আঘাত কর এবং পালাও’Ñ এই রণকৌশলে বরিশালের ‘নলছিড়া’ ক্যাম্পের একজন যোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে অংশও নিলেন তিনি সফলতার সঙ্গে। এরপর একসময় এমনি এক অপারেশনে গুরুতর আহত হয়ে হারালেন একটি পা। আর আহত হওয়ার পরেই সহযোদ্ধারা জানতে পারেন উনি একজন নারী। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান করুণা বেগম। করুণার মতো হালিমা, ফাতেমা, রোকেয়াসহ আরও অনেকে যুদ্ধ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন। শত্রুক্যাম্পে আর যুদ্ধ শেষে পরিবার বা সমাজ তাঁদের গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল ভারতের গোবরায়। ক্যাম্প, কলকাতার পদ্মপুকুর ও পার্ক সার্কাসের মাঝামাঝি তিন জেলায়। পাকসেনাদের হাতে পিতার মৃত্যুর পরে ১৫ বছরের ‘গীতা কর’ যুদ্ধে অংশ নিতে ট্রেনিং নিতে গেলেন যুদ্ধক্যাম্পে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং ও মুক্তিযুদ্ধের। সেখানে ট্রেনিং নিতে এসেছিল গীতার মতো আরও দুই শ’ মেয়ে। এদের সবাইকে যুদ্ধের ট্রেনিং শেষে নিয়োগ দেয়া হয়। আগরতলায় প্রতিষ্ঠিত ৪৮০ আসন বিশিষ্ট হাসপাতালে, যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদানের কাজে। সেখানে তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা ও সেবায় নিরলস শ্রম দিয়ে যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের আবারও যুদ্ধে যাওয়ার উপযোগী করার মহত কাজে উৎসর্গ করেন নিজেদের। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের ডকুমেন্টারি ছবি ‘নারীর কথা’য় দেখানো হয়েছে কীভাবে রংপুরের আদিবাসী নারীরা তীর-বল্লম নিয়ে বাঙালী যোদ্ধাদের সঙ্গে আক্রমণ করেছিল পাকসেনাদের। ‘তাহাদের যুদ্ধ’ আর একটি ছবি। আফসান চৌধুরী এখানে দেখিয়েছেন একেবারে গরিব, নিরক্ষর নারীরা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আহার করিয়েছে, কাপড় ও কম্বল দিয়ে সাহায্য করেছেন। নিজেদের সর্বস্ব কীভাবে এদের পরম যতেœ আগলে রেখেছেন, কতটা দেশপ্রেমে এরা এভাবে এগিয়ে এলেন তা প্রশ্ন রেখে আফসান চৌধুরী বলেছেনÑ ‘পাকসেনাদের সঙ্গে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁদের তুলনায় এসব নারীদের অবদান কি কোন অংশে কম? কারণ এঁরা তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রও বহন করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে গেছেন। যুদ্ধ শেষে যেসব নারী স্বামী, পুত্র ও পিতাসহ সর্বস্ব হারিয়েছিল তাঁদের নামতে হয়েছিল সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ে।’ স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে সীমিত পর্যায়ে প্রস্তুতি পালা নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী। যে বীর নারী রোশনারা সূচনাপর্বে শত্রুপক্ষের একটি প্ল্যাটুন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেন সরকারীভাবে সংগৃহীত দলিলপত্রে সে বিবরণ এসেছে একেবারে সংক্ষিপ্তভাবে। তাঁকে বীর বলা হলেও শহীদ বলা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে খণ্ডিত দলিল হয়েছে সেখানেও নারী মুক্তিযোদ্ধার চিত্র অস্পষ্ট। তৎকালীন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়, ঢাকার একটি গেরিলা স্কোয়াডের প্রধান ছিলেন ফোরকান বেগম, যিনি ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। করুণা বেগমের মতো আরও একজন পুরুষের পোশাকধারী গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন শিরিন বানু, স্টেটম্যান পত্রিকায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে : ‘একসময় আমি মেজর জলিলকে বলেছিলাম কলকাতা থেকে আসার পরে আমার সঙ্গে বিভা সরকার, যুঁথিকা মণিকা ব্যানার্জী, গীতা, ইরাসহ অনেক মেয়ে ছিল যাদের পরে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি।’ সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মনিকা মতিনের ভাষায়, ‘যুদ্ধের সময় নারীরা যেন জীবন্ত রাডারের ভূমিকা পালন করেন। আমি যদিও বন্দুক ভালভাবে চালাতে পারতাম না, তবুও রাতে পাহারা দেয়ার জন্য দাঁড়াতাম।’ বস্তুতপক্ষে সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেদনাদায়ক যে তাদের অনেকের নাম প্রকাশ হতে থাকে স্বাধীনতার অনেক বছর পর থেকে। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকালের লালিত সামাজিক অবস্থা বাঙালী নারীকে ‘অবলা’ ‘অধস্তন’ শ্রেণীভুক্ত করে রেখেছিল, সেই অভিশপ্ত অবস্থান থেকে সরে আসার একটা সুযোগ মুক্তিযুদ্ধে সৃষ্টি হলেও নানা কারণে এর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়নি। আর যে কারণে যুদ্ধের পরে জাতিকে পেতে হয়েছে ধর্ষিত নারীর এক দীর্ঘ তালিকা। অথচ তাঁদের পাশে বীর নারীরও একটা তালিকা হতে পারত। প্রকৃত নারী মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা সরাসরি লড়েছেন, তাঁদের গুটি কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে স্বাধীনতার প্রায় আড়াই দশক পরে। এর কারণ সম্ভবত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। যোদ্ধা নারীকে শ্রদ্ধা জানাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় এবং আর একটি বড় সত্যি অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন দরিদ্র নিরক্ষর পরিবারের। এদের কৃতিত্ব অন্বেষণের পরিবর্তে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে শিক্ষিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। কতজন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা আমরা জানিÑ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে তাঁদের ত্যাগের স্বীকৃতি কতজনকে দিয়েছে এ জাতি?
×