ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মো. সাইফুল ইসলাম

বেগম রোকেয়া ও সুলতানার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

বেগম রোকেয়া ও সুলতানার স্বপ্ন

এই বসুন্ধরার বুকে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ একই দিনে জন্ম ও মৃত্যুবরণ করে। তেমনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও বাংলা তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াও একজন। ৯ ডিসেম্বর পালিত হলো বেগম রোকেয়া দিবস। কারণ এই দিনটিতে তিনি জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন (১৮৮০-১৯৩২)। মাত্র ৫২ বছরের জীবনে তিনি সমগ্র ভারতীয় নারীদের শিক্ষা বিশেষ করে মুসলিম নারী শিক্ষার জন্য ও তাদের অধস্তন অবস্থার পরিবর্তনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আজ এই লেখায় বেগম রোকেয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব না। অনেক কথা ও বর্ণনায় লেখাকে বিস্তৃত করব না। শুধু তাঁর জীবনের দুটি কথা ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে আলোচনা করব। স্রোতের অনুকূল পরিবেশে অনেক মনীষী মহাকালে স্থান করে নেয়। কিন্তু স্রোতের প্রতিকূলে খুব স্বল্প মানুষ মহাকালে স্থান করে নিতে পারে। বেগম রোকেয়া দ্বিতীয় সারির মানুষ। কারণ তিনি জন্মানোর সময় ছিল কঠিন পর্দা প্রথা। আর নারী শিক্ষার প্রতি বিপুল আপত্তি। কিন্তু নিজ চেষ্টায় বেগম রোকেয়া তার বড় ভাই ইব্রাহীম সাহেবের কাছে হারিকেনের মিটমিট আলোতে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। যে শিক্ষা আরও বৃদ্ধি পায় তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের উৎসাহে ও উদ্দীপনায়। সংসার জীবনে তিনি স্থায়ী হতে পারেননি স্বামীর অকাল মৃত্যুতে। তাঁর নিজের দুটি কন্যাসন্তানও পৃথিবী থেকে দ্রুত চলে গেলে তিনি মনস্থির করেন যে, তার শিক্ষা ও সম্পদ দিয়ে নারীদের উন্নয়নে কাজ শুরু করবেন। তাই তিনি ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘গোলকুঠিতে’ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ চূড়ান্তভাবে ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের ভাড়া বাড়িতে স্বামীর নামে স্কুলটি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। যা ইংরেজী ভাষা শিক্ষাদানকারী কলকাতায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পায়। এখান থেকে তিনি নারী শিক্ষার কার্যক্রম ও তাঁর সাহিত্যচর্চা নিয়মিতভাবে পালন করা শুরু করেন। বেগম রোকেয়ার চিন্তার একটি বড় জায়গা ছিল নারীদের অধঃপতন তথা অবনতির জন্য নারী নিজেই দায়ী। তিনি তাঁর ‘বোরকা’ নামক প্রবন্ধে নারীদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। কারণ নারী তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অলঙ্কার ব্যবহারের জন্য অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু শিক্ষার জন্য করে না। তাই তিনি নারীদের বিদ্যা শিক্ষার জন্য পুরুষদের নিকট আর্জি করেন- ‘এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই, তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন। ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তকপাঠে যে অনির্বাচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের- আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ অমূল্য অলঙ্কার- তাই কবি বলেন, ‘চোরে নাহি নিতে পারে করিয়া হরণ, জ্ঞাতি নাই নিতে পারে করিয়া বণ্টন, দান কৈলে ক্ষয় নাই হয় কদাচন, এ কারণে বলে লোকে বিদ্যা মহাধন।’ বেগম রোকেয়া আরেকটু বাড়িয়ে বলেন-, ‘অনলে না পারে ইহা করিতে দহন, সলিলে না পারে ইহা করিতে মগন, অনন্ত অক্ষয় ইহা অমূল্য রতন,- এই ভূষা সঙ্গে থাকে যাবতজীবন।’ এভাবে বেগম রোকেয়া উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, নারী ও পুরুষ সমাজকে যাতে অর্থের বিনিময়ে সঠিকভাবে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন আর অবনতি থেকে উন্নতি করা যায় তার জন্য কাজ করতে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বেগম রোকেয়ার এক অনবদ্য সৃষ্টি। এই লেখাটির মাধ্যমে বেগম রোকেয়া দেখাতে চেয়েছেন নারীরা পুরুষের তুলনায় কত সুন্দর ও সুচতুরভাবে রাষ্ট্র তথা দেশ পরিচালনা করতে পারেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখাটি পড়ার সময় নিজের অজান্তেই বার বার বাংলাদেশর বর্তমান ছবিটি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে।
×