ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুডইয়ার্ড কিপলিং অসামান্য গল্পের জাদুকর

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

রুডইয়ার্ড কিপলিং অসামান্য গল্পের জাদুকর

‘শব্দই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা মানুষ দ্বারা ব্যবহত হয়।’ কথাটি এমন একজন মানুষের যিনি শব্দের জাদুকর। কথা সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের। জন্মেছিলেন বৃটিশ ভারতের বম্বো শহরে। পুরো নাম যোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিং। বেশ বড়ই। তবে বিশ্ব সাহিত্যে তিনি রুডইয়ার্ড কিপলিং নামেই পরিচিত। পড়াশোনা করেছিলেন ইংল্যান্ডে কিন্তু ১৮৮২ সালে আবার ফিরে এসেছিলেন ভারতে নাড়ির টানে। এ বছরই বিয়ে করেন ক্যারোলিন ব্যালিস্টিয়ার। এরপর তারা ভারমন্ট এ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এই ভারমন্টে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য জাঙ্গল বুক’। সেটা ছিল ১৮৯৪ সাল। ‘গুঙ্গা দিন’ও এখানেই থাকাকালীন লিখে ফেলেন। যেটা তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া লেখকে পরিণত করে। কিপলিং-এর জন্মের কিছুকাল আগে তাঁর বাবা এবং মা অন্য অনেক ব্রিটিশের মতো ভাগ্য অন্বেষণে ভারতের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন শিল্পী। কিপলিংয়ের কাছে ভারত ছিল এক বিস্ময়। এখানকার মানুষ এবং তাদের সহজ সরলতা মুগ্ধ করত শিশু কিপলিংকে। ছোট বোন এলিসকে নিয়ে স্থানীয় বাজারে গৃহপরিচারিকার সাথে ঘুরতে যেতেন প্রায়শই। তিনি স্থানীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং এখানকার মানুষের প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু মাত্র ৬ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের সাউথ সিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। তিনি ফস্টার পরিবারে জায়গা পান। কিন্তু বিধি বাম। সংসারের কর্ত্রী মিসেস হলোওয়ে ছিলেন একজন নির্দয় মহিলা। তিনি প্রায়শই ছোট্ট কিপলিংকে অত্যাচার করতেন। যে কিনা তখন স্কুলের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। তবে কিপলিং ছোটবেলা থেকেই গল্পের বইয়ে শান্তি খুঁজতেন। তাঁর খুব অল্পই বন্ধু ছিল। ড্যানিয়েল ডিফো, র‌্যালফ ওয়ালডো এমারসন, উইলকি কলিনস প্রমুখের বইয়ের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। কিপলিংয়ের বয়স যখন ১১, তখন নার্ভাস ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। সৌভাগ্যক্রমে এক আত্মীয় তাকে দেখে অনতিবিলম্বে কিপলিংয়ের মাকে জানায়। তাঁর মা ইংল্যান্ডে ফিরে এসে মিসেস হলোওয়ের কাছ থেকে সরিয়ে তাকে রাহুমুক্ত করে। তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় ডেভনের একটি স্কুলে। এটি ছিল তাঁর জীবনের যুগান্তকারী ঘটনা। এখানেই কিপলিং লেখার জন্য তাঁর মনোযোগকে একীভূত করেন। মজার তথ্য হচ্ছে এই বয়সেই তাকে স্কুলের ম্যাগাজিনের সম্পাদক বানানো হয়। ১৮৮২ সাল। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের পরিবার তাকে জানিয়ে দিল যে তাদের পক্ষে আর পড়াশোনার খরচ যোগানো সম্ভব নয়। তাকে অবিলম্বে ভারতে ফিরে যেতে বলা হয়। পরিবারের সাথে লাহোরে বাস করতে শুরু করেন তিনি। বাবার সহায়তায় একটি সংবাদপত্রের অফিসে কাজ নিতে সক্ষম হন। অফিসের কাজ শেষ করে শহরের অলিতে গলিতে ঢুঁ মারতেন তিনি। কখনো আফিমের আড্ডায় কখনো বা আবার পতিতালয়ে। এই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ৪০টি ছোটগল্পের স্বমন্বয়ে ‘প্লেইন টেলস ফ্রম দি হিলস’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। যা কিনা ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে যায়। ১৯১৫ সালে তিনি ফ্রান্সে ভ্রমণ করেন যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। নিজের ছেলে জনকে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। স্ত্রী জোসেফাইনের মৃত্যুর পর আসলে জন এবং কিপলিং খুব কাছাকাছি চলে আসেন। নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে পাঠান তিনি। কিন্তু চোখের দৃষ্টি স্বল্পতার কারণে ব্যর্থ হয় জন। কিন্তু অবশেষে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি জনকে আইরিশ গার্ডে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ভর্তি করাতে সক্ষম হন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না কিপলিংয়ের। ১৯১৫ সালের অক্টোবরের দিকে খবর আসে যে ছেলে জনকে ফ্রান্সে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবসাদগ্রস্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েন কিপলিং। নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। কারণ তিনিই জনকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিয়েছিলেন। ছেলেকে খুঁজে বের করতে ফ্রান্স যাত্রা করেন কিপলিং। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একমাস পরে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। ১৯৮৯ সালের এক দুপুরে লন্ডনের রাস্থায় এক আগন্তুকের সাথে পরিচয় হয় কিপলিংয়ের। ওয়ালকট ব্যালেস্টিয়ার নামে একজন আমেরিকান এজেন্টের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। যিনি একজন প্রকাশকও ছিলেন। খুব দ্রুতই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারা দুজনে একসাথে আমেরিকাতে ভ্রমণ করেন। সেখানে ব্যালেস্টিয়ার কিপলিংকে অন্য নামী লেখকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ব্যালেস্টিয়ার এর সাথে পরিচয় কিপলিংয়ের জীবন বদলে দেয়। তিনি প্রকাশ করেন তার ছোট গল্পের বই ‘উই উইলি উইনকি’ (১৮৮৮) এবং ‘আমেরিকান নোটস’ (১৮৯১)। ১৮৯২ সালটা ছিল কিপলিংয়ের জন্য বিশেষ একটি বছর। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য প্রতিভার বিস্ফরণ। নাম ছিল ‘বারাক-রুম ব্যালাডস’। ব্যালেস্টিয়ার এর বোন চেরীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কিপলিংয়ের। এরই মধ্যে ভারতে বেড়াতে যান কিপলিং। সেখানেই হঠাৎ চেরীর তার পান। টাইফয়েডে ভুগে হঠাৎ করেই মারা গিয়েছে ব্যালেস্টিয়ার। চেরী এই সময়ে তার পাশে থাকার অনুরোধ জানায়। ছুটে যান কিপলিং। মাত্র আট দিনের মাথায় তারা এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দু’জন দু‘জনকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে সারা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেছেন। কিপলিং মূলত এটিই ছিল তার লেখার রসদ। ১৮৯৩ সালে তাদের প্রথম কন্যা সন্তান হয়। নাম রাখা হয় জোসেফাইন। দ্বিতীয় কন্যা জন্ম নেয় ১৮৯৬ সালে। তার নাম রাখা হয় এলসি। ১৮৯৭ সালে জন্ম নেয় জন। প্রথম একমাত্র পুত্র সন্তান। ১৮৯২ সালে তিনি রচনা করেন ‘দ্য নওলাখা : এ স্টোরি অব দ্য ওয়েস্ট এন্ড ইস্ট’। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া লেখক। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘পাক অব রকস হিল’। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘এ্যাকশন এন্ড রিএ্যাকশন’। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ডেবটস এন্ড ক্রেডিটস’। ১৯৩২ সালে বাজারে আসে ‘লিমিটস এন্ড রিনিউয়াল’। তবে জীবনের শেষ সময়টা একদম ভালো কাটেনি কিপলিংয়ের। মারাত্মক আলসারের সমস্যায় ভুগছিলেন। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৩৬ সালের এক পড়ন্ত বিকেলে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই অসামান্য শব্দের জাদুকর। ওয়েস্টমিস্টার এ্যাবের কবরস্থানে কবিদের সমাধি ক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়। যেখানে তাঁর পাশে রয়েছেন টমাস হার্ডি আর চার্লস ডিকেন্স।
×