ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শুরু হচ্ছে মূল নির্মাণ কাজ ;###;প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন আজ

পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতুর সাত নম্বর পিলার। এটি দাঁড়াবে ছয়টি পাইলের মধ্য। আর এই ছয়টি পাইলের তিন নম্বর পাইলের কাজ দিয়েই সূচনা। এই সার্ভিস পাইলটির কাজের শুভযাত্রার মধ্য দিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। যা হবে বাঙালী জাতির নতুন এক বীরত্বগাথার ইতিহাস। বিজয়ের মাসের নতুন এই সাফল্যটিকে স্মরণীয় করতে চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। যা ঘিরে পদ্মা পারের প্রাচীন জনপদে বিরাজ করছে উৎসবমুখর বিশেষ এক পরিবেশ। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই উৎসবটি না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। মাওয়া ও জাজিরাসহ পদ্মার দু’পাড় ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। যে সেতু নিয়ে দেশ-বিদেশে এত আলোচনা সেই সে সেতুর প্রায় ২৭ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে গেছে। পরিকল্পনামাফিক চলছে সবকিছু। এই হিসাব অনুযায়ী তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুতে চলবে গাড়ি ও ট্রেন। দেশের দীর্ঘতম ও এ সেতু উন্মুক্ত হলে দেশের অর্থনীতির চাকার গতি বাড়বে বৈপ্লবিকভাবে। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে এক দশমিক দুই শতাংশ। তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবন যাত্রায় যে পরিবর্তন ঘটবে, এই হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। দক্ষিণ বঙ্গের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল পদ্মা সেতু ও নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। এ নিয়ে সেতুর দুই প্রান্ত মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ও শরীয়তপুরের জাজিরায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সেতুর জন্য দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকেবে। এই সেতু হয়ে গেলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদ। এই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে। এশিয়ান হাইওয়ের রুট হিসেবেও এই সেতু ব্যবহার করা হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া রাজধানীর সঙ্গে পদ্মা সেতুর যোগাযোগ সহজ করতে মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। এদিকে পদ্মা সেতুর মূল পাইলের সফল পরীক্ষা শুক্রবার বিকেল ৫টায় সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের এই তথ্য নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেছেন, ২ হাজার ৪শ’ কিলো জুল ক্ষমতার হ্যামার দিয়ে এই পাইল স্থাপন করা হবে। প্রায় ১০টি বোয়ইড বিমানের ক্ষমতার ন্যায় ক্ষমতা এই হ্যামারের। এই পাইল স্থাপনে মোট ৫টি হ্যামার ব্যবহৃত হবে। এর মধ্যে বাকি চারটির ক্ষমতা যথাক্রমে ৫শ’ কিলো জুল, ৫শ’ কিলো জুল, ৮শ’ কিলো জুল এবং ১২শ’ কিলো জুল। সার্ভিস পাইল স্থাপনে প্রচ- শব্দ হয়। এর কাজ শুরু করার মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী এই এলাকাটি অতিক্রম করবেন। পরে মাওয়া প্রান্তে মূল সেতুর আনুষ্ঠানিক ফলক উন্মোচন করা হবে। পাইল স্থাপনের সফল পরীক্ষার পর সেতু সংশ্লিষ্টরা আনন্দে উদ্বেল। দীর্ঘ প্রচেষ্টার সফলতা সূর্য উঠবে এই অপেক্ষায় এখন তারা। পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় গত মার্চে। পাইলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হবে সেতুর স্প্যান (পিলার)। পিলারের ওপর বসবে সেতুর সø্যাব ও ট্রাস। চীনে সø্যাব ও ট্রাস বানানোর কাজ চলছে। পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে সø্যাব ও ট্রাস জুড়ে দেয়া হবে। বিপুল কর্মযজ্ঞ ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়া ও জাজিরার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিপুল কর্মযজ্ঞ। দেশী-বিদেশী হাজার হাজার শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের ভীষণ ব্যস্ততা প্রকল্প এলাকাজুড়ে। প্রকৌশলীরা জানান, এতদিন পরীক্ষামূলক পাইলিং চললেও এবার শুরু হবে মূল পাইলিং। পদ্মা সেতুর মূল কাজের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আবদুল কাদের জানান, ইতোমধ্যেই সেতু নির্মাণের ২৭ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, নদী শাসন কাজের ১৩ শতাংশ এবং সংযোগ সড়কের উভয়প্রান্তে প্রায় ৬০ শতাংশ স¤পন্ন হয়েছে। সেতু নির্মাণে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ২০০১ সালের ৪ জুলাই এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর পদ্মায় অনেক পানি গড়িয়েছে। কিন্তু সেতু হয়নি। সাড়ে ১৪ বছরের মুখে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তব রূপ পেতে চলেছে স্বপ্নের সেতু। আয়তন ও নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুটি বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু। সর্বশেষ সংশোধনীর পর এর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসনের মতো জটিল কাজও শেষ হয়েছে। গত ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সেতুর ১৪ দশমিক ৯ ভাগ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কাজ শেষ হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ ভাগ। নদী শাসনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৮ ভাগ। কাজ হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৩ ভাগ। জাজিরাপ্রান্তে সংযোগ সড়কের ৭০ দশমিক ৪৯ ভাগ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ হয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ ভাগ। মাওয়াপ্রান্তে সংযোগ সড়কের ৬৭ দশমিক ৩১ ভাগ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ হয়েছে ৫৯ দশমিক ৮৭ ভাগ। মূল সেতু নির্মাণ চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এমবিইসি)। চার বছরের চুক্তিতে গত বছরের ২৬ নবেম্বর সেতুর কার্যাদেশ দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সেতু নির্মাণে সময় লাগবে তিন বছর। এমবিইসির কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডটি বিশাল। এখানেই তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল পাইল। চীন থেকে সাগর পথে বাংলাদেশে এসেছে পাইলিং পাইপ বানানোর ইস্পাতের পাত। ৬০ মিলিমিটার বা দুই দশমিক ৩৬ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাতগুলো। একেকটির ওজন ১৩ টন। এসব ইস্পাতের পাতকে প্রবল শক্তির বেন্ডিং মেশিন দিয়ে সিলিন্ডারের আকৃতি দেয়া হচ্ছে। তিন দশমিক দুই মিটার বা ১০ ফুট ব্যাসের একেবারে নিখুঁত গোলাকার ২৫টি সিলিন্ডার একত্রে যোগ করার পর হচ্ছে একেকটি পাইলিং পাইপ। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীরা জানান, ইস্পাতের পাতগুলো শতভাগ স্টেইনলেস। পানির নিচে ১শ’ বছরেও কিছু হবে না। যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু ওয়েল্ডিং নয়, গ্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে কোথাও যেন এক চুল ফাঁকফোকর না থাকে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাইলিং পাইপ তৈরির পর, ইয়ার্ড থেকে বসানো রেললাইনের মাধ্যমে নদীতে নেয়া হচ্ছে। সেখান থেকে হাজার টনের ক্রেনের মাধ্যমে নেয়া হবে সেতুর নির্মাণস্থলে। এমবিইসি মূল সেতু নির্মাণ করলেও পুরো পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন তদারক করছে সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। নদীর তলদেশ থেকে আড়াআড়িভাবে পাইলিংয়ের গভীরতা হবে ১১৭ মিটার। তবে কেন্দ্র থেকে গভীরতা হবে ১০১ মিটার। জার্মানি থেকে আনা এক হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক হাতুড়ির মাধ্যমে পোঁতা হবে পাইলিং পাইপগুলো। তবে নকশা অনুযায়ী কাক্সিক্ষত পাথরের স্তর পাওয়া না গেলে সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারার আশঙ্কা রয়েছে। ১০ ফুট ব্যাসের পাইপগুলো রড, সিমেন্ট, পাথরের ঢালাইয়ে পূর্ণ করা হবে। এগুলোই হবে সেতুর পিলারের ভিত্তি। নদী শাসনের দায়িত্বে রয়েছে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো। আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রান্তে ১২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। মাওয়া প্রান্তে নদীর তীর ঘেঁষে চলছে নদীশাসনের জন্য কংক্রিট ব্লক তৈরির কাজ। একই কাজ চলছে জাজিরা প্রান্তে এক বর্গকিলোমিটারজুড়ে। প্রকৌশলীরা জানালেন, ১৮ লাখ ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে নদীতীর বাঁধাই করা হবে। যাতে সর্বনাশা প্রমত্তা পদ্মা আর না ভাঙ্গে। সেতু যেন অটুট থাকে। সিনো হাইড্রোর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, বিশাল মেশিনের সাহায্যে প্রতি মিনিটে চারটি ব্লক তৈরি হচ্ছে। সেগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে নদীর তীরে। সংযোগ সড়কের কাজ করছে আবদুল মোনেম ও মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান এইচসিএম কনস্ট্রাকশন। জাজিরা প্রান্তে ১২ কিলোমিটার ও মাওয়াপ্রান্তে দুই কিলোমিটার সড়কের কাজ চলছে। ৪২টি পিলারের ওপরে দাঁড়াবে পদ্মা সেতু ॥ বিশাল এই সেতুটি মোট ৪২টি পিলারের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকবে। ৪০টি পিলার থাকবে নদীর ভেতরে অংশে। আর দুটি থাকবে দুই প্রান্তে সংযোগ সেতুতে। নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ৬টি করে পাইল করতে হবে। এ জন্য মোট ২৪০টি পাইল করতে হবে। আর সংযোগ সেতুর দুটি পাইলে ১২টি করে ২৪টি পাইল করতে হবে। সর্বমোট ২৬৪টি পাইল করতে হবে ৪২টি পিলারের জন্য। একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব হবে ১৫০ মিটার। ৬টি মডিউলে বিভক্ত সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতুর মাওয়াপ্রান্তে এক হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট (ঝুলন্ত পথ) থাকবে। জাজিরাপ্রান্তে ঝুলন্ত পথ থাকবে এক হাজার ৬৭০ মিটার। এই ঝুলন্ত পথগুলো সেতুকে এ্যাপ্রোচ রোডের (সংযোগ সড়ক) সঙ্গে যুক্ত করবে। প্রায় তিন দশমিক ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্টে থাকবে ৮১টি পিলার। রেললাইনের জন্য দুই প্রান্তে ৫৩২ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হবে ১৪টি পিলারের ওপর। পদ্মাই হতে চলেছে দেশের প্রথম দ্বিতল সেতু। এর উচ্চতা হবে ১৩ দশমিক ৬ মিটার বা প্রায় ৪৪ ফুট। নিচতলায় (লোয়ার ডেক) ট্রেন চলবে। মিটার ও ব্রড গেজ উভয় ধরনের ট্রেন চলাচলে ডাবল গেজ রেললাইন থাকবে। দ্বিতীয় তলায় (আপার ডেক) চলবে গাড়ি। আপার ডেকের প্রস্থ হবে ৭২ ফুট। ফুটপাথ ও সেতুর রেলিংয়ের জন্য দুই পাশে আড়াই মিটার করে জায়গা থাকবে। সেতুর ওপরে চার লেনের রাস্তার প্রস্থ হবে প্রায় ৫৬ ফুট। দুই ডেককে আলাদা করা হবে আড়াআড়িভাবে বসানো ট্রেসের মাধ্যমে। ট্রেন ও যানবাহন চলাচল ছাড়াও সেতুতে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ থাকবে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য। ৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসবে অপটিক্যাল ফাইবার ও টেলিযোগাযোগের লাইন স্থাপনে। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনেরও ব্যবস্থা থাকবে। এই সেতুর বদৌলতে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস পৌঁছাবে। বিদ্যুতের ঘাটতিও দূর হবে। পুরনো কথা ॥ দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মা সেতু। ১৯৯৮-৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সম্ভাবতা যাচাই করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর নক্সার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। তবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে এই সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ নবেম্বর কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এরপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কর্তৃপক্ষ এ বছরের মার্চে চীনের প্রথমত মাওয়ায় পদ্মার পাড়ে দুটি গরু, দুটি ছাগল ও দুটি মোরগ জবাই করে সেগুলোর রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে। আট মাস পর আজ সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজের উদ্বোধন হচ্ছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ার পদ্মা পারের মৎস্য আড়তের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি থেমে যায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। চারদলীয় জোট সরকার ও সেনাশাসিত ফখরুদ্দিনের সরকার এ নিয়ে আর তেমন একটা এগোয়নি। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আবারও পদ্মা সেতু নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে। শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ। চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকাসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু মাঝ পথে থেমে যায় পদ্মা সেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সকলে ধরে নিয়েছিল এ সরকারের পক্ষে এ সেতু করা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু আজ স্বপ্নœ বাস্তবায়ন হচ্ছে। কোন ষড়যন্ত্রই আটকাতে পারেনি এ সেতুর কাজ। আর এসব কিছুই হচ্ছে এ দেশের জনগণের টাকায়। স্থানীয় সংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের এই সফলতা শুধু বাঙালীর বীরত্বগাথাই নয়, দেশের অগ্রগতির মাইলফলক। এই অঞ্চলের অগ্রগতির নানা সম্ভাবনা কথা উল্লেখ করে এই সাংসদ বলেন, অনেক সম্ভাবনা চোখের সামনে এসেছে যা আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। অবদান অনেকের ॥ সেতুর জন্য বহু মানুষের অবদান রয়েছে। ভূমি দিয়েও অবদান রেখেছেন অনেকে। এলাকার খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও বাদ যাননি। বাপ-দাদার ভিটামাটি ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ভূমিহীনদের সরকার প্লট তৈরি করে দিয়েছে। শুধু জমিদাতাদের জন্যই নয়, যারা ভাড়াটিয়া তাদের জন্যও সরকার বিনা মূল্যে প্লট করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর জন্য জমি দিতে সংশ্লিষ্ট মালিকদের রাজি করাতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, যাকে এ অঞ্চলের মানুষ আপা বলে ডাকে, তিনি সাবেক হুইপ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এমপি। সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন উপলক্ষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনিও আনন্দিত। দিনরাত কাজ করছেন তিনি উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য। সেতুতে অবদান রাখার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের কাছে। শুধু সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলিই নন, সেতুর জন্য জমি দিয়ে অবদান রাখার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দৈনিক জনকণ্ঠ সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, দৈনিক কালের কণ্ঠ সম্পাদক কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ লিপুর পরিবারও। গাজী আশরাফ লিপু জানান, জমি যাওয়ার কষ্টের চেয়ে পদ্মা সেতু হওয়ার ভাললাগা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। শরীয়তপুর ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আজ সকালে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর নদী শাসনের কাজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাওডোবায় পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্টের কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে তৈরি করা হয়েছে সমাবেশ মঞ্চ। এখানেই উদ্বোধনী ভিত্তিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। ওড়ানো হয়েছে রংবেরঙের পতাকা, সুসজ্জিত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের পথ। নদী শাসনের ভিত্তিফলক উন্মোচনের পর প্রধানমন্ত্রী এখানে সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী নদীপথে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় যাবেন। নদীর পাড়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে নিরাপদ ঘাট। শুক্রবার দিনভর শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নাওডোবায় বিভিন্ন কাজের তদারকি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে পদ্মা পাড়ের নাওডোবায় দেখা দিয়েছে উৎসবের আমেজ। এখানের মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানাতে।
×