ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্যারিস সম্মেলনে হঠাৎ পাল্টে গেল দৃশ্যপট

ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি নয় উন্নত দেশগুলো

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

ক্ষতিপূরণ দিতে  রাজি নয় উন্নত  দেশগুলো

কাওসার রহমান, প্যারিস থেকে ॥ বাংলাদেশসহ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আশার আলো নিভে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে আরও একটি খসড়া দলিল প্রকাশের পর হতাশা নেমে এসেছে জলবায়ুর ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধি দলের মাঝে। নিষ্প্রাণ কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডের মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সার্বজনীন জলবায়ু চুক্তি। জলবায়ুর ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দায় দায়িত্বে বিষয়টি বাদ গেছে সর্বশেষ দলিল থেকে। অর্থায়নের বিষয়ে এখনও কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি বিশ্বের ১৯৫টি দেশের সমঝোতাকারীরা। ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি একটি অন্তঃসারশূন্য জলবায়ু চুক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সমন্বয়কারী ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সর্বশেষ খসড়া আমাদের আরও পিছিয়ে দিয়েছে। কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন থেকে এখানে কোন অগ্রগতি নেই। উন্নত দেশগুলো সেই পুরানো গীত গাইছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, খসড়া চুক্তি থেকে উন্নত দেশগুলোর আপত্তিগুলো উঠে গেলেও এটি আমাদের জন্য কোন জোরালো চুক্তি হবে না।’ তিনি বলেন, ‘অর্থায়নের বিষয়েও কোন অগ্রগতি নেই। ছয় বছর আগে কোপেনহেগেন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো বলেছিল, ২০২০ সালের পর প্রতিবছর তারা ১০০ বিলিয়ন করে সহায়তা দেবে। ২০২০ সালে গিয়ে এই অর্থের কোন মূল্য থাকবে না। আমরা চাইছি, এই অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন অগ্রগতি নেই।’ ড. আহমদ বলেন, আমরা চেয়েছিলাম জলবায়ু তহবিল থেকে সহজ পদ্ধতিতে অর্থায়ন। যাতে আমরা সহজে অর্থ পেতে পারি। সে বিষয়টিও চুক্তিতে উপেক্ষা করা হয়েছে।’ বুধবার রাতে জলবায়ুু সম্মেলনের সভাপতি চুক্তির একটি খসড়া দলিল প্রকাশ করেন। সেটিতে বাংলাদেশের ইস্যুগুলো স্থান পাওয়ায় প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল। রাত থেকে সেই খসড়ার ওপর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা শুরু হয়। বৃহস্পতিবার দিনভর আলোচনার পর গভীর রাতে আরও একটি খসড়া প্রকাশিত হয়। যা জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। এই খসড়া নিয়ে শুক্রবার অপরাহ্ন ৩টায় আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে শুক্রবারের মধ্যে এই আলোচনা শেষ করে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফ্যাবিয়াস। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আলোচনার সময় আরও একদিন বাড়বে। অর্থাৎ প্যারিস জলবায়ু আলোচনা শেষ করতে শনিবার লেগে যাবে। জলবায়ু সম্মেলনের সময় বৃদ্ধি নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রতিবছরই আলোচনা একদিন বৃদ্ধি পায়। কোন কোন বছর এই আলোচনা শেষ করতে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। দুই সপ্তাহের জলবায়ু সম্মেলনে সময় বৃদ্ধি যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশের প্যারিস জলবায়ু আলোচনার চিত্র একদিনেই পাল্টে গেছে। প্রথম খসড়া থেকে অনেক কিছুই বাদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোই বাদ পড়েছে দ্বিতীয় খসড়া থেকে। স্বল্পোন্নত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মূল ইস্যু লস এ্যান্ড ডেমেজ (জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি) এর ব্যাপারে উন্নত দেশগুলো দায়-দায়িত্ব গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে পিছিয়ে এসেছে। প্রথম খসড়ায় এ বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকলেও দ্বিতীয় খসড়ায় তা বাদ পড়েছে। এ বিষয়টি দেখভালের জন্য ওয়ারশো ম্যাকানিজম অনুযায়ী, একটি ফ্যাসিলিটেটর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল প্রথম খসড়ায়। দ্বিতীয় খসড়ায় সেটিও বাদ দেয়া হয়েছে। স্বল্পোন্নত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অতীতে অগ্রাধিকার সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। এখন সেটিও বাদ দেয়া হয়েছে। এখন সব দেশকে একই কাতার নিয়ে আসা হচ্ছে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায়। তবে জলবায়ু উদ্বাস্তু ইস্যুটি মাইগ্রেশন সুবিধাসহ-ই স্থান পেয়েছে দ্বিতীয় খসড়ায়। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর দায়-দায়িত্বের স্থানে সকল দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে উন্নত দেশগুলো জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় অর্থায়ন করতে বাধ্য থাকবে বলা হয়েছিল। এখন সকল দেশকে মিলে এই অর্থায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও বাদ যাবে না। জলবায়ুর মিটিগেশন ও এ্যাডাপটেশন কার্যক্রমে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থায়নের অবস্থানেই রয়েছে উন্নত দেশগুলো। অর্ধেক মিটিগেশনে ও অর্ধেক অর্থ এ্যাডাপটেশনে প্রদানে দাবি স্থান পায়নি দ্বিতীয় খসড়ায়। এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী থেকেও সরে যাওয়া হচ্ছে। এখন এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। এটি এখন মূলত ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, ২০১৮ সালে প্রাকাশিতব্য আইপিসিসিসির রিপোর্টের ওপর। ওই রিপোর্টে বৈশ্বিক উষ্ণতা কতটা বাড়বে তার বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে। প্রয়োজনে কার্বন নির্গমন হ্রাসের পরিমাণ আরও কমানোর প্রতিশ্রুতি বাড়ানো হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিভিল সোস্যাইটির প্রতিনিধি ড. গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘চুক্তির খসড়ায় অর্থায়নের বিষয়টি উপেক্ষিত আছে এখনও। অর্থায়নের বিষয়ে সমঝোতা না হলে চুক্তিটি অর্থহীন হয়ে পড়বে।’
×