ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বোমা মেরে তেলের ডিপো উড়িয়ে দিলেন সুন্দর আলী

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

বোমা মেরে তেলের ডিপো উড়িয়ে দিলেন সুন্দর আলী

মুক্তিযোদ্ধা সুন্দর আলী নয় বছর ধরে শয্যাশায়ী। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। সুন্দর আলী ছিলেন ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। আদমজী জুট মিলে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চলে যান ভারতের মেলাঘর ও বাঘমারায়। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনারগাঁও ও বন্দর থানার বিভিন্ন স্থানে পাক সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি নিজ হাতে অনেক পাক সেনাকে হত্যা করেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল বার্মাস্ট্যান্ডের জ্বালানি তেল ডিপো থেকে হানাদার পাক বাহিনীর জন্য জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। আগস্ট মাসে জালকুড়ি গ্রামের তমিজউদ্দিন দেওয়ানের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের সিদ্ধান্ত হলো জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। উড়িয়ে দেয়া হবে তেল ডিপো। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত শ্রমিক নেতা রেহান উদ্দিন রেহান। এ অপারেশনের অংশ নেন, মোমতাজউদ্দিন ভূইয়া, মোহর আলী, ছোট রশিদ, বদরুদ্দিন ও নূর ইসলাম। থানা কমান্ডার ইসলাম হোসেনও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। রাত ১২টায় জালকুড়ি গ্রাম থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বিল পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা সড়ক অতিক্রম করে ইসমাইলের বাড়িতে উঠলাম। কে কোন কাজ করবে, কে কোন জায়গায় দাঁড়াবে, আবার অপারেশন শেষ করে কিভাবে ফিরবে এ নিয়ে আলাপ হলো। ঠিক হলো আমাকে ডিপোর ভেতরে ঢুকে জ্বালানি ট্যাঙ্কিতে বোমা (এক্সপ্লোসিভ) ফিট করতে হবে। তেল ডিপোর তারের বেড়ার ৫০ গজ দূরে তেলের ট্যাঙ্কি। ২০ গজ দূরে পাক সেনারা মেশিন গান হাতে পাহারা দিচ্ছে। তারা ২/৩ মিনিট পর পর ট্যাঙ্কির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। এ সময়ের মধ্যে ট্যাঙ্কিতে বোমা ফিট করতে হবে। একটু হেরফের হলেই পাক সেনারা দেখে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলবে। তখন রাত ১টা। আমার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গির পেছনে ২টি গ্রেনেড গুঁজে হাতে ৫৫ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ নিয়ে সময় বুঝে পাক সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়লাম ডিপোতে। এ সময় ইসমাইল এলএমজি হাতে দাঁড়ালেন। আর দু’জন দু’টি স্টেনগান নিয়ে আমগাছের ওপর উঠে বসলেন। যদি পাক সেনারা এসে পড়ে, তাদের প্রতিহত করা হবে। ডিপোতে ঢুকে তেলের ট্যাঙ্কিতে এক্সপ্লোসিভ ফিট করলাম। পরে আবার একই পথে ফিরে এসে কর্ড নিয়ে আবারও ভেতরে ঢুকলাম। ট্যাঙ্কি থেকে ৫০ হাত লম্বা তার দিয়ে ইসমাইলের কাছে পর্যন্ত নিয়ে এলাম। এরপর ইসমাইল সিগারেট জ্বালিয়ে ফিউজে ১০ মিনিট সময় নির্ধারণ করে তাতে আগুন ধরিয়ে সবাইকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ইসমাইলের বাড়ি ফিরে রেললাইনে ওঠার ২/১ মিনিট আগে ১৫/২০টি রাইফেল থেকে গুলি করল পাক সেনারা। গুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে সবাই পাশে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের উপস্থিতি পাক সেনারা টের পেয়ে গেছে। পাক সেনারা রেললাইনের পশ্চিম পাশে পজিশন নেয়। আমরাও গুলি করি। এক সময় আমরা পুকুরে ঝাঁপ দিলাম। এদিকে পাক সেনার গুলিতে পুকুরের কচুরিপানা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি আমার পাশে পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন ইসমাইল। এ সময় বিকট শব্দে ডিপোর ভেতরে ট্যাঙ্কিতে বোমা ফাটল। বোমার শব্দে মনে হলো পুকুরও কেঁপে উঠল। বোমার শব্দে পাক সেনারা ভয় পেয়ে গুলি ছোড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ সুযোগে আমরা (আমি ও ইসমাইল) জালকুড়ির রাস্তা ধরে হেঁটে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট আস্তানায়। সেখানে পৌঁছে দেখলাম অন্য সবাই ভিন্ন ভিন্ন পথে আমাদের আগেই পৌঁছে গেছে। ওরা ভেবেছিল পাকবাহিনীর গুলিতে আমরা মারা গেছি। আমরা যখন জালকুড়ি পৌঁছলাম তখন মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। Ñমোঃ খলিলুর রহমান নারায়ণগঞ্জ থেকে
×