ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

তুরিনের যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

তুরিনের যুদ্ধ

গভীর রাত। ঝমঝম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে ঘুম মাহবুবার ঘুম ভাঙে। একই সঙ্গে দরজায়ও নক করার শব্দ। হারিকেনের আলোয় দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে দশ বছরের মেয়ে তুরিন। কিন্তু দরজা খুলে মন ভাল হয়ে যায়। দেখে ওর বাবা খলিল দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা কাপড় বদলে বিছানায় বসল। তাকে ঘিরে বসেছে তুরিন। বিছানার ওপর রাখা স্টেনগান, দুটি গ্রেনেড আর কিছু এক্সপ্লোসিভ। তুরিনের আম্মু মাহবুবা কোন কথা না বলে খুব দ্রুত খাবারের ব্যবস্থা করছে। তুমি খুব অবাক হয়েছো? খলিল মেয়েকে জিজ্ঞেস করল। তুরিন বলল, হ্যাঁ। খুব অবাক হয়েছি। তুমি কীভাবে এলে? এত রাতে কেন? এগুলো কী বাবা? খলিল হাসতে হাসতে বলল, তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেব? এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে কেউ করে? তুরিন হাসে। হাসলে তাকে খুব সুন্দর দেখায়। এতদিন পর বাবাকে দেখে অবাক তো হবেই। চার মাস আগে মুক্তিবাহিনীতে গেছে। এরপর আর কোন খোঁজ নেই। আজ গভীর রাতে আনন্দে আত্মহারা। মাহবুবা খাবার নিয়ে এসেছে। রাতের কিছু ঠা-াভাত আর টেংড়া মাছের তরকারি গরম করে আনল। এই ভাত খেতে খেতেই বলল, সাদুল্লার ব্রিজটি উড়াতে এসেছিলাম। বৃষ্টির জন্য কাজ করতে পারিনি। অন্যরা চলে গেছে। আমি রয়ে গেলাম। ব্রিজটি উড়িয়ে পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেব। মাহবুবা চিন্তিত। ভয়ও পাচ্ছে। আস্তে আস্তে বলল, রাজাকাররা যেভাবে ঘোরাঘুরি করে যদি টের পায়? টের পাবে না। আমি ঘর থেকে বের হব না। দিনের বেলায় ধানের ঢোলায় শুয়ে থাকব। তুরিন বলল, ধানের ঢোলায়। আহ্ হা। খলিলের খাওয়া হলে তুরিন এবার বাবাকে ধরল, এসব কী ভাল করে বলো। আমিও তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যাব। বাবাও হাসল। আহ্ হা। যা বললি পিচ্চি মেয়ে। তোকে তো বাতাসেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আবার যুদ্ধ! যুদ্ধ মানে কি চড়ইভাতি খেলা। বাবা বরাবরই মেয়ের সঙ্গে হাসি-তামশা করে। মজা করে কথা কয়। আজও তাই। একমাত্র মেয়ে বলে আদরের সীমা নেই। তুরিন তবু জোর করে ধরল। আমাকে এসব কী বলতেই হবে। শেখাতেও হবে। মেয়েকে খুশি করার জন্য খলিল স্টেনগান, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ সম্পর্কে বলল। তুরিনকে হাতে নিতে বলল। কীভাবে ব্যবহার করতে হয় বুঝিয়ে বলল। তুরিন বলল, আমি একটা গুলি ছুড়তে চাই বাবা। আরে না পাগল মেয়ে। শব্দ শুনে রাজাকার চলে আসবে। তারপর সবাইকে খতম করে দেবে। এই বৃষ্টির মধ্যে স্টেনগানের শব্দ এত দূর যাবে? আর বৃষ্টির মধ্যে রাজাকার জেগে থাকবে। ওরা তোমার মতো বোকা? আহ্ হা। যা বললে রে মা তার জবাব নেই। চল বারান্দায় গিয়ে দেখাই। বাবা বারান্দায় গিয়ে আরও একটা লেকচার দিল। তুমুল বৃষ্টি। ঝড়োবাতাস। অন্ধকার। মেঘের ডাক। এসব শব্দের মধ্যে স্টেনগানের শব্দ বড় তুচ্ছ। কোথায় হারিয়ে যাবে! তুরিন গুলি করল। পর পর তিনটি। তুরিন খুশিতে আত্মহারা। রাতেই ধানের বড় ঢোলার উপর একটা বিছানা করে। খলিল এখানেই থাকবে। তারপর ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে আবার চলে যাবে। খলিল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে এই খবরটি পাড়ার সবাই জানে। বাড়িটি একবার পুড়িয়ে দিতে রাজাকাররা এসেছিল। তবে কি কারণে জানে আবার পোড়ায়নি, হয়ত বাবাকে হাতেনাতে ধরবে সেজন্য। রাতে বৃষ্টিতে ভেজার কারণে রাত থেকেই খলিলের গায়ে প্রচ- জ্বর। দু’দিন হয়ে গেল জ্বরটা কমছে না। মাহবুবা ওষুধের ব্যবস্থা করতেই ঝামেলাটা পাকিয়ে ফেলে। খলিলের বাড়ি আসার খবরটি রাজাকারদের কাছে পৌঁছে যায়। বিকেলেই এসে অসুস্থ খলিলকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায় পাঁচটি রাজাকার। অসুস্থ বাবাকে এত অপমানজনকভাবে ধরে নিয়ে গেছে যা তুরিন কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। মাহবুবা কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নিয়েছে। বেঁহুসের মতো পড়ে আছে বিছানায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। তুরিন ভাবছে, আজ রাতই বাবাকে মেরে ফেলবে। মাও আধমরা হয়ে গেছে। স্টেনগান, গ্রেনেড এক্সপ্লোসিভ রাখা ছিল গোয়ালঘরের তুষের গোলায়। রাজাকাররা মারপিট করলেও খলিল অস্ত্রের কথা স্বীকার করেননি। আজও বৃষ্টি। রাজাকারদের ক্যাম্প এক মাইল দূরে। সন্ধ্যার পর তুরিন স্টেনগান আর দুটি গ্রেনেড নিয়ে বের হয়ে পড়ে। জীবন দিয়ে হলেও বাবাকে বাঁচাতে হবে। একটা স্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প। স্কুলটি বন্ধ। গ্রামের সাধারণ মানুষকে ওরা ধরে নিয়ে আসে। নির্যাতন করে। তারপর সময় হলে মেরে ফেলে। অথবা টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। তবে খলিল সাধারণ মানুষ নয়। খলিল মুক্তিযোদ্ধা। তাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। মৃত্যুই তার একমাত্র শাস্তি। স্কুলের পেছনে একটা জঙ্গল। তুরিন আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভেতরে ঢোকে। স্ট্যানগানের সেফটি পিনটা পরীক্ষা করে দেখে কী অবস্থায় আছে। স্কুলের পশ্চিম আর দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে ঘন জঙ্গল। তুরিন আস্তে আস্তে স্কুলের দক্ষিণ পাশের বেড়ার সঙ্গে মিশে দাঁড়ায়। একটু সামান্য ফাঁক দিয়ে হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাবাকে। এই তো! পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা। মাটিতে বসে আছে। আহারে কত কষ্ট। হয়ত মারধরও করেছে। তাহলে রাজাকারগুলো কোথায়? তুরিন আস্তে আস্তে বেড়া ঘেঁষে সামান্য পূর্বদিকে গিয়ে দেখে সেখানে ছয়টি রাজাকার চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। এখনই সুযোগ। এই সুযোগকে আর হাতছাড়া করা যায় না। বৃষ্টিই মঙ্গল। ব্রাস। ফায়ার। হঠাৎ এই ঘন বৃষ্টির রাতে এভাবে কেউ আক্রমণ রাজাকারগুলো কল্পনাও করতে পারেনি। গুলি খেয়ে চারজন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর দুজন মাইর‌্যালছে গো। মাইর‌্যালছে বলতে বলতে দৌড়াতে লাগল। তুরিন তাড়াতাড়ি স্কুলের ভেতরে ঢুকে বাবার দড়িটি খুলতে সাহায্য করে। দুজনে দড়িটি খুব সহজেই খুলে ফেলে। বাঁধনমুক্ত হয়ে বাবা বলল, আমার কাছে স্টেনগানটা দাও মা। খলিল পড়ে থাকা রাজাকারগুলোকে আরেক দফা গুলি করে তুরিনকে নিয়ে পালিয়ে যায়। গায়ে জ্বর থাকলেও এখন তা তুচ্ছ। খলিল বাড়িতে এসে তুরিনকে কোলে নিয়ে লাফাতে থাকে। এত আনন্দে মায়ের চোখে পানি। খলিল বলল, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। এখনই শত্রু আমাদের ঘিরে ফেলবে। তোমরা তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে এসো। রাতের অন্ধকারে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ওরা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
×