শংকর কুমার দে ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আঠারো বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্বদানকারী মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বিদেশে পলাতক দুই আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদেশে অবস্থান করেও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী এই দুই আলবদর নেতা। ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান খান অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মাঈনুদ্দিন আছেন যুক্তরাজ্যে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের অনুপস্থিতিতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর তাদের মৃত্যুদ- দেয়া হয় তাদের। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার বিদেশে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে অনেক আগে থেকেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। আর যারা বিদেশ পলাতক আছে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের এই দুই কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক এবং তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার মামলায় মৃত্যুদ- দেয়া হয় আশরাফ- মুঈনুদ্দীনকে। তারা দুজনে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কীভাবে আলবদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন, তা উঠে এসেছে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের রায়ে।
আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন সেই হত্যাকা-ের ‘চীফ এক্সিকিউটর।’ আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ।’
কে এই চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ॥ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের জন্ম ১৯৪৮ সালের নবেম্বরে, ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে মুঈনুদ্দীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মুঈনুদ্দীন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের একজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্য। সেই হিসেবে পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতেও তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষ ভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুঈনুদ্দীন পালিয়ে চলে যান পাকিস্তানে। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দাওয়াতের বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। মুঈনুদ্দীন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন পরিচালক, মুসলিম এইডের ট্রাস্টি এবং টটেনহ্যাম মসজিদ পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। একাত্তরে ‘পাকিস্তানে অখ-তার’ পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে স্বীকারও করেছেন মুঈনুদ্দীন।
আশরাজ্জামান খানের পরিচয় ॥ আশরাফুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪৮ সালে, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভিগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রী পান ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা আলবদর বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব আশরাফুজ্জামানের ওপর বর্তায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং বাস্তবায়নকারী নেতা হিসেবেও তাকে অভিযুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে আশরাফুজ্জামান খানের ঠিকানা নিউইয়র্কের জ্যামাইকা। ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফ।
জিয়া ও এরশাদের আমলে ॥ জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সরকারের আমলে পুলিশ প্রহরায় মুঈনুদ্দীনকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়। এই দুই সামরিক শাসককেও ধিক্কার জানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে। বলা হয়েছে, এটা জাতির বড় একটি বিরাট লজ্জা (গ্রেট শেম) যে, জিয়া ও এরশাদ তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে দিয়েছেন। আত্মগোপনে গিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এই আসামিকে সে সময় পুলিশী নিরাপত্তাও দেয়া হয়। বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় মেশিনারি দিয়ে সম্মান দেয়া হলো বলে উল্লেখ করা হয় রায়ের পর্যবেক্ষণে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। এ জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনতে আইনী জটিলতার অন্যতম বাধা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ কিংবা পশ্চিমা বেশিরভাগ দেশ-ই যে কোন বিচারে মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে একটি অবস্থানে এসে পৌঁছেছে এবং এই অবস্থানের কারনে চৌধুরী মুইনুদ্দীনকে বাংলাদেশে ফেরত নেবার ক্ষেত্রে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রেও আইন যুক্তরাজ্যের মতোই বলা যায় এক রকমএ যদিও যুক্তরাষ্ট্র এর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি যুক্তরাজ্য থেকে কম। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রে অবস্থানটাও কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে কূটনৈতিক তৎপরতায়, যেমনটায় বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি মহিউদ্দিন আহম্মেদকে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছিল। তবে আন্তঃদেশীয় উষ্ণ সম্পর্ক, কূটনৈতিকভাবে ভাল যোগাযোগ, ভূরাজনৈতিক নানা কৌশলের মাধ্যমেও এই ধরনের আপাতদৃষ্টিতে জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: