ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনযুদ্ধে পরাজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার কথা কেউ শোনেনি, প্রধানমন্ত্রী কি শুনবেন-

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

জীবনযুদ্ধে পরাজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার কথা কেউ শোনেনি, প্রধানমন্ত্রী কি শুনবেন-

ফিরোজ মান্না ॥ রণাঙ্গনে ছিলেন তিনি অসীম সাহসী। একের পর এক যুদ্ধক্ষেত্র জয় করেছেন। জীবনের মায়া ভুলে পাকি হানাদারদের বহু ক্যাম্প গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সিলেটের এক যুদ্ধে ১৫-২০ জনের পাকি সেনা দলকে হত্যা করে গড়ে তোলেন বীরত্বের গৌরবময় ইতিহাস। সেদিনের সেই গৌরবময় ইতিহাস তার জীবনে ম্লান হয়ে ফুটে উঠেছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো হুঙ্কার দিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল তঁাঁর কাজ। যুদ্ধজয়ের ইতিহাস তার বীরত্বের হলেও জীবনযুদ্ধে তিনি চরম পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গ্লানি আর বেদনার অশ্রু ভেজা অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে-খেয়ে, না খেয়ে। পরিবার পরিজন নিয়ে তার জীবনে এখন ঘোর অন্ধকার। চোখের আলোও তার নিভে গেছে। অন্ধত্ব নিয়ে তার আর কিইবা করার আছে। কেইবা তার পাশে এসে দাঁড়াবেন? পাশে নেই কেউ পরাজিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। পরাজিত এই সৈনিকের নাম তারা মিয়া। ধূসর চেহারার তারা মিয়ার সাহস যুদ্ধকালীন যেমন ছিল এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষুধা-দারিদ্র্য অসহায় করে তুলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়াকে। রোগ-শোকে শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। বয়স বেড়েছে ঢের। এখন আর নেই সেই তাকত। ক্ষুধা-দারিদ্র্য নামের শত্রুকে জয় করার ক্ষমতা নেই শরীরে। সম্প্রতি তারা মিয়া দৈনিক জনকণ্ঠ প্রধান কার্যালয়ে এসেছিলেন। তিনি তার অসহায়ত্বের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। তার বীরত্বগাথার কথা এখন আর শহর-বন্দর-গ্রামের কেউ শোনে না। সংবাদ মাধ্যমে তার দুঃখের কথা ছাপা হয়েছে। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর চোখ তারা মিয়ার দুঃখের জীবন গল্প কেউ পড়েনি। তার গল্প কেবল সংবাদপত্রের পাতায়ই থেকে গেল। নজর কাড়ল না সরকারের কোন কর্তা ব্যক্তির। বহুবার মুক্তিযুদ্ধের সব সনদ নিয়ে সরকারের অনেক দফতর ঘুরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। শেষ গন্তব্য হিসেবে তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে এসে বললেন, আমার কথা কারও কানে পৌঁছে না। জনকণ্ঠ কি আমার কণ্ঠ শুনবে। জনকণ্ঠ তার কণ্ঠ শুনেছে। কিন্ত যারা তারা মিয়ার জন্য বড় কিছু করতে পারবেন তারা কি একটিবার তারা মিয়ার কণ্ঠ শুনবেন? শুনলে হয়ত তারা মিয়াসহ তার পরিবারের জীবন দুঃখ কিছুটা ঘুচতে। তিনি তার যুদ্ধকালীন বীরত্বের ইতিহাস একটিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শোনাতে চান। কিন্তু তিনি কি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। এই সরকারের কাছ থেকেও তিনি কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি। হায়রে কপাল! কোথায় দাঁড়াবেন তারা মিয়ার মতো অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের জীবন কি এমনি করেই কেটে যাবে? ৭৪ বছরের বেশি বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার পক্ষে পরিবার-পরিজনের দু’বেলা খাবারের সঙ্গতি নেই। তিস্তার ভাঙ্গনে প্রতিবছর এ কূল থেকে ও কূলে বসতি গড়তে গড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। ভাঙ্গনের শিকার এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মাসিক ভাতার দেড় হাজার টাকাই সম্বল। বর্তমানে ভাতার পরিমাণ বাড়লেও সেই টাকা তিনি এখনও হাতে পাননি। দেড় হাজার টাকা দিয়েই পাঁচজনের সংসার চলছে খেয়ে না খেয়ে। জীবন সংগ্রামে পরাজিত এই সৈনিকের নিদারুণ অভাবের কথা দেশের অনেক মানুষ জানলেও কেউ বড় ধরনের সাহাস্য নিয়ে এগিয়ে আসেননি। যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা এবং কিছু হিতাকাক্সক্ষীর সহযোগিতায় কোন রকমে দিন পার করছেন তিনি। তার বীরত্বের কথা ও জীবন সংগ্রামে পরাজিত হওয়ার কথা বহুবার পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তির চোখেও পড়েছে হয়ত। কিন্তু তাতে তার ভাগ্য বদল হয়নি। নীতিবান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কখনও কারও কাছে সাহায্যের হাত পাতেননি। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যকে নিজের মধ্যে চেপে রেখেই মানুষের সঙ্গে চলেছেন। কিন্তু বয়সের ভারে এখন তিনি আর পথ চলতে পারছেন না। পরিবার-পরিজন চালাবেন কিভাবে দিনরাত এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া তার জীবনের সুখ-দুঃখের হাজারও কথা এই প্রতিবেদকের কাছে বলে কিছুটা হাল্কা হয়েছেনÑ কিন্তু অভাবের বিরাট পাথরটি তার বুক চেপে বসে আছে। এখান থেকে তিনি কিভাবে হাল্কা হবেন। তারা মিয়া বলেন ‘আমার কথা যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুনতে পান তাহলে জীবনে আমি পরম শান্তি পাব।’ এই শান্তির জন্য এতটা দিন অপেক্ষা করে আছি। বঙ্গবন্ধুকন্যাই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ আশ্রায়স্থল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে তারা মিয়ার কথাগুলো এখনও পৌঁছেনি। কবে তার দুঃখের কথা জানবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই অপেক্ষা করতে করতে এখন তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থান করছেন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এই সৈনিকের দুঃখের দিন কবে শেষ হবে তিনি তা জানেন না। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সবার মতো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ গ্রামের তারা মিয়াও যুদ্ধে অংশ নেন। প্রচ- সাহসী তারা মিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এলএমজি চালাতেন। হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া সিলেটের রোহিনীঘাট ও ঘোড়াঘাটের এক যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে কখনও উত্তেজিত আবার কখনও নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। কথা বলতে বলতে তিনি কান্নাও করেন। রোহিনীঘাট ও ঘোড়াঘাটে পাকি হানাদারদের ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পের সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কোন যুদ্ধেই মিত্রবাহিনী জয়ী হতে পারেনি। পরে নবেম্বরের শেষদিকে ৬ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী বীরবিক্রমের নেতৃত্বে ৪২ জনের একটি দল পাকিদের আক্রমণ করেন। এই দলে তারা মিয়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বর্বর পাকি হানাদারদের একের পর এক হত্যা করতে থাকেন। যুদ্ধে ৫৭ পাকি সেনা নিহত হয়। এর বেশিরভাগকে হত্যা করেছিলেন তারা মিয়া। ওই যুদ্ধের বীরত্ব তাকে সেনাবাহিনীর নিয়মিত চাকরি পাইয়ে দেয়। তিনি বলেন, সেদিন বহু পাকি সেনাকে তিনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। তাদের বন্দী করা হয়। পাকিদের ক্যাম্প থেকে বহু যুবতী অনাবৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। আমরা সেদিন ওই সব মা-বোনকে বুকে তুলে নিয়েছিলাম। এ কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন। পাকিদের বর্বরতার ক্ষতচিহ্ন তাদের শরীরে দেখে চোখের পানি রাখতে পারিনি আমরা। এভাবে একের পর এক যুদ্ধ জয় করেন তিনি। কিন্তু কি নির্মম-নিষ্ঠুর বাস্তবতা! স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মধ্যে তার ইতিহাস বিবর্ণ হয়ে গেছে। ধূসর ইতিহাস নিয়ে তিনি আজ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনের কোথাও যদি একটুখানি আপোস করতেন তাহলে তিনিও হয়ত বাড়ি-গাড়ির মালিক থাকতেন। তা তিনি করেননি। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তখন তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন তিনি ছেলের বাবা হয়েছেন। সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈনিক হিসেবে বেশিদিন বাড়িতে থাকতে পারেননি। ছুটি শেষে তাকে চাকরিতে যোগদান করতে হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে তিনি ছিলেন ব্যস্ত। এর মধ্যে তার ছেলে আনোয়ার হোসেনের চোখে ইনফেকশন দেখা দেয়। তার স্ত্রী গ্রাম্য ডাক্তার-কবিরাজ দেখায়। এরপর ছেলের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে আনোয়ার অন্ধত্ব নিয়ে বেড়ে উঠছে। আজ তার বয়স ৪১ বছর। অন্ধ ছেলের চিকিৎসা করাতে পারেননি। ডাক্তার বলেছে, কর্নিয়া সংযোজন করলেই সে দেখতে পাবে। একটি কর্নিয়ার জন্য তারা মিয়া জীবনে বহু মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোন আশার কথা শোনেননি। এরপর তিনি পত্রিকা অফিসেও ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়েছেন- সাড়া পাননি। অন্ধ ছেলের পর তার একটি মেয়ে ও দুটি ছেলে হয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ ছেলে রবিউল বিয়ে করে পৃথক হয়ে গেছে। ছোট ছেলে রফিকুল গাইবান্ধা কলেজ থেকে বিএ অনার্স পাস করেছে। এই ছেলের একটা চাকরি হলে তার জীবনের দুঃখের অবসান ঘটত। চাকরি জীবনে তিনি সেনাবাহিনীতে বক্সার ছিলেন। বক্সিংয়ে বহুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। মেজর জেনারেল (অব) নূর উদ্দীন যখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি ছিলেন তখন বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। সে সময় তাকে সিপাহী থেকে ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ওই স্মৃতির গৌরব তার এখনও অম্লান। চাকরি জীবন শেষ করার পর বক্সিং ফেডারেশনে অনারারি প্রশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেখানে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। তাকে চক্রান্ত করে বের করে দেয়া হয়। এতে তার কোন দুঃখ নেই। ইতিহাসসমৃদ্ধ জীবন রয়েছে তার। কিন্তু জীবন চলার পথে অতীতের সব গৌরবের ইতিহাস ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। তার সরাসরি কমান্ডার কর্নেল (অব) এমদাদ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, তারা মিয়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানি। তার বীরত্বে আমাদের কোম্পানি রণাঙ্গনে এক গৌরবময় ইতিহাস অর্জন করে। তার সাহসের কাছে আমরা নিজেরাই অনেক সময় ভয় পেয়ে যেতাম। সেই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি আজ বড় করুণ-অসহায়। আমরা যার সহযোদ্ধা ছিলাম তারা তাকে সামান্য কিছু সাহায্য করতাম। কিন্তু কতদিন আর এই কাজ করা যায়। সকলের অবস্থাই প্রায় তারা মিয়ার কাছাকাছি। মাঝে মাঝে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে তারা মিয়া ঢাকায় আমার বাসায় আসেন। আমি আর কিইবা করতে পারি। আমার আপসোস ছাড়া আর করার কিছুই থাকে না। এমন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে তা ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগে। অথচ কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা টাকার পাহাড়ের ওপর ঘুমাচ্ছেন। জাতির কি দুর্ভাগ্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বাড়তি সময় চাকরি করে যাচ্ছে। তারা মিয়ার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যখন না খেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয় তখন মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার জীবনের গৌরবগাথা আর দুঃখ- বেদনার কথা শুনতে শুনতে অনেক সময় কেটে যায়। কিন্তু তাঁর কথা শেষ হচ্ছিল না। তিনি বলতেই থাকেন। অভিমানী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কোনদিন কারও কাছে হাত পাতেননি। আজও তিনি হাত পাতার কথা একবারও বলেননি। তবে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারপ্রধানের কাছে তার জীবনের কথাগুলো বলতে চান। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে বীরত্বের একদিন না একদিন পৌঁছবেই। যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা জানতে পারবে তার বীরত্বগাথা ইতিহাস এটাই তার বড় পাওনা। আর কিছু নয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি সহযোগিতা করতে চান তাহলে ট্রাস্ট ব্যাংকের যে কোন শাখা থেকে ০০০২-০৩১০২৮৪৩৬৭ এই হিসাব নম্বরে সহযোগিতা করতে পারেন অথবা তার ০১৭৬১১৫৯৪২১ এই মোবাইল নম্বরে সরাসরি কথা বলেও তাকে সাহায্য করতে পারেন।
×