ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরদার সিরাজুল ইসলাম

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার

’৭১-এর ঘাতক বিএনপির নেতা কুখ্যাত সাকা চৌধুরী এবং জামায়াতের আইকন বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক মুজাহিদকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হলো। কাকতালীয়ভাবে একই মঞ্চে একই সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরা ভেবেছিল যে শেষ পর্যন্ত তারা হয়ত ক্ষমা পাবে সেজন্য তারা রাষ্ট্রপতির কাছে ’৭১-এর অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল কিন্তু তাদের অপরাধ এত জঘন্য যে তাদের ক্ষমা করার এখতিয়ার এ রাষ্ট্রের নেই। এই বিচার কার্যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দিয়ে শেখ হাসিনা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করলেন এবং প্রমাণ করলেন যে, এ বিচার সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বচ্ছ। উল্লেখ্য, ন্যুরেমবার্গ খ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রায়ালে আপীলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বিচার প্রক্রিয়া তথা মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে মাত্র ১৬ দিনে। বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এই বিচার বন্ধের জন্য এবং আসামিদের ছেড়ে দেয়ার জন্য অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা মাথানত করেননি। সাকা চৌধুরী ভেবেছিল যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে অতীতে (ব্রিটিশ আমলে) তার পিতার সঙ্গে যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল সেই সূত্রে হয়ত তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে এসবের কোন মূল্য নেই। আরেক রাজাকার চূড়ামণি নিজামী ইতোপূর্বেই ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। যা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ’৭১-এর অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে তার মৃত্যুদ- এখন আপীল বিভাগে বিচারাধীন। যার রায় হওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৬ জানুয়ারি ২০১৫। শেষ পর্যন্ত নিজামী উচ্চ আদালতে মৃত্যুদ-ের সাজা হ্রাস করার আবেদন জানিয়ে বস্তুত স্বীকার করেছেন যে, তারা ’৭১-এ গণহত্যায় হানাদার বাহিনীকে মদদ জুগিয়েছে এবং তারা নিজেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। জাতি এটিও দ্রুত নিষ্পত্তি অর্থাৎ মৃত্যুদ- কার্যকর দেখতে চায়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, এলডিএফ বিরোধিতা করলেও কেবলমাত্র জামায়াত দলগতভাবে পাক সহযোগী সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রথমে রাজাকার পরে আলবদর ডেজিগনেশন নিয়ে সশস্ত্র হয়। বেতন ছিল। গেজেটে নাম আসে। বাংলাদেশে পাকবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সিংহভাগ ছিল এদের কারণে। পাকবাহিনী পথ-ঘাট চিনত না, তাই দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদররা মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিসেনা তাদের ভাষায় ‘জয় বাংলা ও মুজিবের বাচ্চাদের বা কাফের’ মেরে বেহেস্ত যাওয়ার জন্য গাজী বা শহীদ হওয়ার উৎফুল্ল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বাঙালীর বিজয়ে নিশ্চিত হয়ে পাকদোসর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ তখন আলবদর (এখন শিবির) বাহিনী চালিয়েছিল এক জঘন্য নরহত্যা এই ঢাকায়। জামায়াত একটি তালিকা বানিয়েছিল সমাজের বুদ্ধিজীবী হত্যার। ঢাকায় তখন কারফিউ। ১৩ ডিসেম্বর ওদের ছিল ইপিআরটিসির কাদা মাখানো একটি মাইক্রোবাস। নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে স্বজনদের সামনেই ‘আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে স্যার’ বলে সেই যে নিয়ে গেল প্রথমে মোহাম্মদপুরে আলবদর হেড কোয়ার্টারে। সেখান থেকে গভীর রাতে (১৪ ডিসেম্বর) রায়ের বাজার ‘বধ্যভূমি’ এলাকায় হত্যা করার পরে মরদেহ শনাক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর। এই সব বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বী, ডাঃ মোহাম্মদ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান প্রমুখ। শহীদুল্লা কায়সারের লাশ শনাক্ত হয়নি বিধায় তার ভাই জহির রায়হান ৩০-১২-৭১-এ মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিজেও নিখোঁজ হন ১২-১-৭২ তারিখে। ডাঃ আলীম চৌধুরীকে (চক্ষু চিকিৎসক) ধরিয়ে দেয়ায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন প্রতিবেশী প্রয়াত মাওলানা মান্নান (এরশাদের মন্ত্রী ও ইনকিলাবের মালিক)। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭২ সালের দালাল আইনে রাজাকার-আলবদরসহ পাকবাহিনীর সহযোগীদের বন্দী করা হয়। সাপ্তাহিক অর্থনীতি ১৮ ডিসেম্বর ’৮৮ সংখ্যায় প্রকাশ ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত উক্ত আইনের অধীনে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে বন্দী করা হয়েছিল এবং একই সময় পর্যন্ত বিচার হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের যার মধ্যে দ-প্রাপ্ত হয় ৭৫২ জন। অনেকের ফাঁসির হুকুমও হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমায় (সাধারণ ক্ষমায় যা খুন, ধর্ষণ, লুটেরার জন্য ছিল না) মুক্তিলাভ করেছিল ৩৬৪০০ দালাল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১-১২-৭৩ইং তারিখে এ তথ্য প্রকাশ করেন (ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্ট-বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- পৃঃ ৫০)। মওদুদ আহমদের ‘বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ গ্রন্থের ইংরেজী ভার্সান পৃষ্ঠা ৪৮-৫০ উল্লেখ রয়েছে যে, দালাল আইনে আটক হয়েছিল মশিউর রহমান যাদু মিয়া (আগস্ট ’৭৩), এটি মৃধা (মে ’৭৩), জবেদ আলী, মোহাম্মদ হোসেন, লুৎফুল মৃধা, আব্দুর রহমান বকুল (আগস্ট ’৭৩), এ কে এম নাজমুল হুদা, হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ নুরুদ্দিন (আগস্ট ’৭৩) প্রমুখ। পাক বাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। এরা ২ বছর আটক থাকার পরে যুদ্ধবন্দী বিনিময় চুক্তির অধীনে পাকিস্তানে ফেরত যেতে সক্ষম হয়। এছাড়া ছিল অবাঙালী নাগরিক যারা পাকিস্তানে যেতে চায়। তাদের সদস্য এখনও আছে। বঙ্গবন্ধু সরকার এদের মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে তদন্ত শেষে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শনাক্ত করেন ১৭-৪-৭৩ তারিখে। দিল্লীতে ঢাকা-দিল্লী যৌথ ঘোষণায় এদের বিচার হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৭ এপ্রিল দিল্লী ঢাকায় এসে বিবৃতি প্রদান করেন। কিন্তু এই ইশতেহার প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকা পাকিস্তানের একজন উচ্চপদস্থ সহকারী কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করে, “বাংলাদেশ যদি যুদ্ধ বন্দীদের ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য বিচার করে তবে পাকিস্তানে সমসংখ্যক উর্ধতন বাঙালী সামরিক অসামরিক কর্মকর্তার বিচার করবে”। অথচ তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী নয়। কেবলমাত্র তারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চেয়েছে এই অপরাধে তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রতিশোধমূলক বিচারের পাঁয়তারা করেছিল ভুট্টো। উল্লেখ্য, সঠিক তথ্য না থাকলেও পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালী কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সামরিক বাহিনীতে ২৬ হাজার এবং বেসামরিক কয়েক লাখ। ভুট্টোর এ ধরনের হুমকির ফলে পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীদের কথা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। (বিচিত্রা ২৭-৪-৭৩)। তবে জুলফিকার আলী ভুট্টো ওয়াদা করেছিলেন যে, ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার তারা করবেন বরং টিক্কা খানকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। ’৭৫-এ মুজিবকে হত্যা করে জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়ে কিন্তু মুজিব হত্যার প্রধান নায়ক ভুট্টোর শেষ রক্ষা হয়নি। ’৭৭-এ জিয়াউল হক তাকে হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়া দালাল আইন সব উঠিয়ে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী খুনী-আলবদর-রাজাকার সবাইকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। যা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ’৭৫-এর পরবর্তীতে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জামায়াতকে এত শক্তিশালী এমনকি ২০০১ সালে ২ জন যুদ্ধাপরাধী জামায়াতী নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী করেছিলেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচন করলেন জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে এবং সরকার গঠন করলেন তাদের ৩টি মহিলা আসন দিয়ে। জামায়াত এবং বিএনপি এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। আজকের ’৭১-এর ঘাতকদের মুক্তির জন্য খালেদা জিয়া ব্যর্থ দাবি জানিয়েছিলেন। সাকার মৃত্যুর পরে তারা শোকার্ত হয়ে বলেছিলেন যে, সাকা একজন ভাল মানুষ ছিল। আর মুজাহিদের জন্য তাদের ব্যথা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাননি। কাকতালীয়ভাবে একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জামায়াত ও বিএনপি সম্পর্ক কত গভীর ও অবিচ্ছেদ্য যে সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি একই মঞ্চে একই মুহূর্তে অর্থাৎ এক দড়িতে। সে যাই হোক, যুদ্ধাপরাধীর বিশেষ করে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারে শেখ হাসিনা বিশ্বের সকল রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছেন, তাই তো এ বছর বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর মধ্যে তার অবস্থান ১৩তম। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×