ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের সেতু বাস্তবে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

স্বপ্নের সেতু বাস্তবে

১২ ডিসেম্বর শনিবার বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন লালিত পদ্মা সেতুর স্মারক ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন তিনি সাত নম্বর পাইল স্থাপনের মধ্য দিয়ে মূল পাইলিংসহ নদীশাসন কাজেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। আরও যা উল্লেখ্য, তা হলো, নিজস্ব অর্থায়নে এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এটি নির্মিত হলে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে সংযুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চল। এই সেতুতে রেল যোগাযোগ ছাড়াও যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ে। অর্থনীতিবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চার হবে এবং দারিদ্র্য ও অনগ্রসরতা কমবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। কৃষিপণ্য ও কুটির শিল্পের চলাচল সুগম ও সহজসাধ্য হবে। শিল্পায়নের গতি বাড়বে দক্ষিণে। সর্বোপরি প্রাণ সঞ্চার হবে মংলা বন্দরে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে হংকংয়ের আদলে পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত হবে সুপ্রশস্ত চার লেন সড়ক। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে তৈরি হবে ৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক। তবে পদ্মা সেতুকে ঘিরে এতসব অমূল্য ও আশাব্যঞ্জক পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও এর শুরুটা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। কুসুমাস্তীর্ণ তো নয়ই। বরং এই সেতুকে ঘিরে পদে পদে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, বাধা-বিঘœ ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়েছে সরকারকে। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ফেব্রুয়ারিতে পরামর্শক নিয়োগ করে পদ্মা সেতুর নকশার জন্য। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ালে সরকার নিজে উদ্যোগ নেয় পদ্মা সেতু নির্মাণের। জনসাধারণ সরকারের এই উদ্যোগকে বিপুলভাবে সমর্থন জানায়। যেটা দুঃখজনক তা হলো, বিশ্বব্যাংকের এহেন টালবাহানা এবং অর্থায়ন বন্ধের পেছনে একশ্রেণীর দেশীয় ব্যক্তি এবং এনজিও কলকাঠি নেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাংক আজ পর্যন্ত কথিত দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে এই সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কার্যাদেশ দেয়া হয় ২৬ নবেম্বর। আট মাসে প্রকল্পের ২৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি বলতেই হবে সন্তোষজনক। এর মধ্যে সেতুর কাজের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, নদীশাসন কাজের ১৩ শতাংশ এবং উভয় অংশে সংযোগ সড়কের প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর মূল সেতু এবং আনুষ্ঠানিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজে আরও গতিসঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়। প্রতিনিয়ত একূল-ওকূল-ভাঙ্গা গড়ার জন্য বিতর্কিত প্রমত্তা পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। ইতিহাসের কতই না উত্থান-পতন সৃজনের সাক্ষী সতত প্রবহমান পদ্মা। সেই পদ্মা বাধা পড়ছে মানুষের করতলে, প্রযুক্তির যাঁতাকলে। তাই বলে পদ্মার মহিমা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মলিন হবে না কখনও। মহাকালের সাক্ষী হয়ে সে স্বগৌরবে, স্বমহিমায় এগিয়ে নিয়ে যাবে মানব সভ্যতাকে। এখানেই নিহিত পদ্মা নদী ও পদ্মা সেতুর সার্থকতা।
×