ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

বিজয়ের মাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাক হানাদারদের শেষ আশাও মিইয়ে গেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী বুঝে গেল, মার্কিন সপ্তম নৌবহর তাকে সাহায্য করতে আসবে না। ফলে ১৫ ডিসেম্বর সকালে সব আশা ছেড়ে দিল, শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে বিদেশী দূতাবাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করল বিধ্বস্ত নিয়াজী। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ভারত সরকার প্রত্যাখ্যান করলে আরও ভেঙ্গে পড়ে পাক হানাদাররা। মিত্রবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সময় বেঁধে দিল। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা ওই প্রস্তাব পাঠিয়ে দিল দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। এরপর ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের কাছে জানতে চাইল নিয়াজীর এই প্রস্তাবে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সমর্থন আছে কি-না। প্রস্তাবের মূল কথাÑ ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত গোটা পাকবাহিনীকে চলে যেতে দিতে হবে, কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না।’ জেনারেল নিয়াজী মার্কিন দূতাবাসের কাছ থেকে এই আশ্বাস পায় যে, মার্কিন সপ্তম নৌবহর তার লোকজনকে পশ্চিমে নিয়ে যাবে। ঢাকার অন্যান্য বিদেশী দূতাবাস কিন্তু এ সময় আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়েছিল। বিদেশীরাও বুঝেছিল নিয়াজী লড়াই চালিয়ে সুবিধা পাবে না। শুধুই লোক মারা যাবে। ১৫ তারিখ দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকার খবর পেল নিয়াজী শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করতে চায়। কিন্তু ভারত সরকার এ প্রস্তাব নাকচ করে দিল। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে এই আশ্বাস দিতে রাজি যে, যুদ্ধবন্দীরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার পাবে। পাকি জেনারেল নিয়াজীর শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করে এটি তাদের কৌশল। নিয়াজীর প্রস্তাবকে তাদের কাছে মনে হলো এটি যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়। কিন্তু মিত্রবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুতেই রাজি নয়। এজন্য ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। আর এ পর্যন্ত ভারতীয় বিমানবাহিনী কোন আক্রমণ করবে না। এরমধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না পেলে আবার আক্রমণ শুরু করা হবে। জেনারেল মানেক শ’ তাঁর শেষ বার্তায় পিন্ডিকে বলেছিল, সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শোনা যায়, নিয়াজী সেদিন সারারাত ধরে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, দূতাবাসের সাহায্য নেন। কিন্তু পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন মিত্রবাহিনীর গোলার আওয়াজ বাড়তে থাকে। ঢাকার অসামরিক পাকিস্তানীরা ও কয়েকটি বিদেশী দূতাবাসও আত্মসমর্পণের চাপ বাড়িয়ে দিল পাক হানাদারবাহিনীর ওপর। ৪৪ বছর আগে একাত্তরের এদিন মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফের কাছ থেকে শেষ নির্দেশ পান নিয়াজী। নিয়াজীকে জানানো হয়, আত্মসমর্পণের শর্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কথিত পরাক্রমশালী পাকি জেনারেল নিয়াজী। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাত দুটোর মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গায় অবস্থানরত হানাদারবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান। আন্তর্জাতিক চীন-মার্কিন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। চারদিক থেকে ঢাকা অবরুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ না করে কোন উপায় নেই। এদিন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়Ñ ‘ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা মুক্ত বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। দেশের ভেতর বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত লোকজনও বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে।’ এদিকে জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামী ইসলামীর নেতাকর্মীদের অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, আবার অনেকেই আত্মগোপন করেছে। এ সময় সারা বাংলায় উড়ছে রক্তভেজা বিজয় কেতন। এর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
×