ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর রাজাকাররা দিগম্বর

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর  রাজাকাররা দিগম্বর

শিরোনামটি আমার নিজেরই লেখা একটি ছড়া থেকে নেয়া। বেশ ক’বছর আগে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একগুচ্ছ ছড়ার ভেতর এই ছোট্ট দু’লাইনের ছড়াটিও ছিল। ছড়াটি লেখার পেছনে অবশ্যই তখনকার বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক তাগিদ কাজ করেছে। সেই সময় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকি বাচ্চারা দেশে বেশ লম্ফঝম্প শুরু করেছিল। তালেবানী সেøাগান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতর্কিত হামলা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য, কিছু কিছু অঞ্চলে ধর্মীয় সন্ত্রাস চালানো, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অশোভন উক্তি ইত্যাদি নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে দু’লাইনের এই ছড়াটি রচনা করে খুশীই হয়েছিলাম। জনকণ্ঠে ছাপা হওয়ায় ছড়াটি পড়েছেনও অনেকে। আহবাব ভাইর (প্রাক্তন সচিব আহবাব আহমেদ) সঙ্গে দেখা হলে এখনও আমাকে ছড়াটি শুনিয়ে এমন একটা হাসি হাসেন যার অর্থ, একদম খাঁটি কথা লিখেছ। একটা দেয়ালে ছড়ার লাইন দুটো নিয়ে চিকাও দেখেছিলাম। ভাল লেগেছিল। নিজের লেখা বলে নয়, ভাল লেগেছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে ছড়াটি প্রচারণার কাজে লেগেছে বলে। একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছিল বর্বর পাকিসেনাদের পতনের শব্দ। দীর্ঘ নয় মাস ধরে যে পাশবিক নির্যাতন ও নাশকতা চালিয়েছিল পাকি নরপশুর দল তাই ইতিহাসের সকল বর্বরতাকে হার মানায়। কিন্তু তথাকথিত অসীম শক্তিধর পশুশক্তি ডিসেম্বরের শুরু থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল একটু একটু করে। আর ষোল তারিখে সকল দম্ভ, সকল তর্জন-গর্জন বর্জন করতে বাধ্য হয়ে মেনি বেড়ালের মতো মেনে নিল নতজানু পরাজয়। বিজয় নিশান উড়ল ঐ। জয় বাংলা ধ্বনি ধ্বনিত হলো আকাশে বাতাসে। পৃথিবীর মানচিত্রে লেখা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। হাজার বছরের শিকল ছেঁড়া বাঙালী দেখল পূর্ব দিগন্তে মুক্তির লাল সূর্য। কোটি কণ্ঠে গীত হলো ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ্য মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণিÑবাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ সে এক অপার আনন্দের দিন। একই সঙ্গে ঝরল বেদনার অশ্রুধারা। ত্রিশ লাখ বাঙালীর মৃত্যুর বেদনা, দশ লাখ বঙ্গললনার নির্যাতনের বেদনা, সম্পদ লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ-গৃহহীন শরণার্থীর বেদনা, অকথ্য ও অমানুষিক কষ্টের বেদনা। দুঃসহ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে আসা বিজয়ের সঙ্গে তাই সমানভাবে মিশে থাকে আনন্দ আর বেদনার হাজারো কাহিনী। বর্বর পাকিসেনার স্থানীয় দোসর কতিপয় বাঙালী কুলাঙ্গার রাজাকারদের তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। দিনের আলোয় গর্তে লুকানো শৃগালের মতো তারা তখন খুঁজতে শুরু করল পালাবার পথ। রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটির সুবিধাবাদী সদস্য সবাইকে আমি কুলাঙ্গার রাজাকার বলে এক কথায় প্রকাশ করি। মীরজাফর বললে যেমন সকল বিশ্বাসঘাতক বোঝায়, তেমনি রাজাকার বললেই চেনা যায় পাকিবাহিনীর পদলেহী, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী বাংলাভাষী কিছু নরকের কীটদের। নয় মাস ধরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের নির্যাতিত, অত্যাচারিত মানুষের রোষানলের হাত থেকে বাঁচতে রাজাকাররা কাছা খুলে দিগি¦দিক পালাতে শুরু করল। সেই থেকে রাজাকার মানে ভীরু, কাপুরুষ, মেরুদ-হীন কুৎসিত জীব। রাজাকার মানে সুবিধাবাদী ধূর্ত শৃগাল। রাজাকার মানে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর, যারা সুযোগ পেলেই পিঠে ছুরি বসায়। রাজাকার মানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও বাঙালীর চিরায়ত চরিত্রের পরিপন্থী অপশক্তি। রাজাকার মানে পাকিস্তানের পদলেহী পশু। রাজাকার মানে নারী নির্যাতনকারী, চৌর্যবৃত্তে পারদর্শী অসামাজিক প্রাণী। রাজাকার মানে মিথ্যাবাদী, ভ-, লম্পট ইত্যাদি বাংলাভাষার সকল কু-অর্থ বহনকারী শব্দ। এই রাজাকাররা দিনে দিনে একটু একটু করে সংগঠিত হয়েছে। একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করেছে সেই মহান একাত্তরের পর থেকেই। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে তারা সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশেষ করে পুরনো ভৃত্যের মতো পরাজিত পাকিস্তানী প্রভুর সঙ্গে সখ্য গড়েছে গোপনে গোপনে। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছে বারবার। জাতির পিতাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে। ক্রমাগত আক্রমণ করে চলেছে বাংলাদেশ ও বাঙালীর চিরায়ত দর্শনের ওপর। যে দর্শনে রয়েছে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। যে দর্শনে রয়েছে জীবনবাদী শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবিড় মাখামাখি, যা শত সহস্র বছর ধরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহমান, যে দর্শনে রয়েছে সততা-নৈতিকতা-পারস্পরিক সহনশীলতা। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কূলঘেঁষা মানুষ যুগে যুগে বাংলার এই অপূর্ব সুন্দর জীবনদর্শনকে ধারণ করেছেন। মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ এই পূর্ণ্য ভূমিতে দাঁড়িয়েই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপক্ষে লড়েছেন, লড়েছেন অত্যাচারী শত্রুর বিরুদ্ধে। পরাজয় মানেনি কখনও। কোন দুর্বিপাকে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিসত্তার পরম্পরাকে ধারণ করেই হয়েছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি বেঁধেছিলেন এক সুতায়। তিনি ভাল করেই জানতেন কোন হৃদয়বীণার তারে আঙ্গুল ছোঁয়ালে এক সঙ্গে বেজে উঠবে একই সুর, একই তাল। জাগরণের একই সঙ্গীত। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর থেকে বাংলার মানুষ তাই যার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’-নেতার এই ঘোষণায় পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রেখে লড়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। লড়েছেন নানা কৌশলে। বাংলার মানুষকে দাবায়া রাখা যায়নি। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে। তাদের উচ্ছিষ্টভোগী রাজাকাররা এই অপকর্মে সহযোগিতা করেছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার এবং রায় কার্যকর করা নিয়ে পাকিস্তান যা করেছে তা ঘেয়ো কুকুরের আচরণকেও হার মানায়। তারা বারবার প্রমাণ করছে যে তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আমাদের শত্রু ছিল না, তারা এখনও বাংলাদেশের শত্রু। মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা অস্বীকার করে যে মিথ্যাচার পাকিস্তান করেছে, তার জন্য দেশের সকল মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা নেতৃত্বাধীন সরকারের আরও জোরালো ও কার্যকরী পদক্ষপ কামনা করি। সম্প্রতি রাজাকার সাকাচৌ আর মুজাহিদের শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে। গত ২২ নবেম্বর গভীর রাতে তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ঘরে-বাইরে নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা অনমনীয় দৃঢ়তায় রাজাকারদের বিচার করেছেন এবং করবেনও। এ ব্যাপারে তাঁর শত্রুরা দ্বিমত করবে না। বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা এবং সঠিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও কারও কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু পাকিস্তান অনর্গল মিথ্যাচার, অপপ্রচার করেই চলেছে। তারা সরাসরি বিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে আবারও তাদের ন্যাংটো চরিত্র প্রকাশ করেছে। প্রকাশ করেছে যে, একাত্তরের রাজাকাররা তাদের পোষ্যপুত্র এবং এই পদলেহী পোষ্যপুত্রদের সঙ্গে তাদের এখনও গলাগলি সম্পর্ক। ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মীদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন এবং সরকার ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ধ্বংসাত্মক ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা-ের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সরকার এসবের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেছে। দেশে-বিদেশেও হচ্ছে তুমুল প্রতিবাদ। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে পাকিস্তানের কাছ থেকে আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের। ১৯৫ জন কুখ্যাত পাকিসেনা যাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যার প্রমাণ মিলেছে, তাদেরও বিচার করা এখন সময়ের দাবি। আর এই দাবি যে অযৌক্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক নয় তার সপক্ষেও অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে সংশ্লিষ্ট সংগঠন, গবেষকদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বৃত্তর জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের ধৃষ্ঠতার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্মিলিত প্রতিবাদ সৃষ্টি করবে সেটা বিশ্বাস করতে দ্বিধা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্র, জাতি, সরকার ও সমাজ ধ্বংসকারী সকল অপশক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সকল মানুষ ‘এক হোক, এক হোক, এক হোক হে ভগবান’। মহান বিজয়ের মানে চোখে সর্ষে ফুল দেখা রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার বারবার গর্জে উঠুক সেটাই হোক আজকের প্রত্যাশা। জয় বাংলা। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×