ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপম সেন

বাঙালীর মুক্তির স্বপ্নের অসীম তাৎপর্যবহ দিন

প্রকাশিত: ০৮:১০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

বাঙালীর মুক্তির স্বপ্নের অসীম তাৎপর্যবহ দিন

বাঙালী জাতিসত্তা কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে নেগ্রিটো, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের সমন্বয়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে সীতাকুণ্ডে নব্যপ্রস্তর যুগের প্রাগৈতিহাসিক আমলের পাথর পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমাণ হয় এই অঞ্চলে ১০ হাজার বছর আগেও মানববসতি ছিল। আজ যেখানে বাংলা সেখানে একসময় পুণ্ড্র-বঙ্গ-হরিকেল, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তীকালে ঐসব অঞ্চল তাদের নামেই নামাঙ্কিত হয়েছে, পরিচিতি পেয়েছে। এই উপমহাদেশের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে বঙ্গ, অঙ্গ ও পুণ্ড্র-বর্ধণের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও লেখা রয়েছে বঙ্গে তৈরি অতি সূক্ষ্ম সৌখিন বস্ত্রের কথা। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে এই বঙ্গভূমিকে নিয়ে ও তার সীমানা ছাড়িয়ে বৃহৎ পাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, যা প্রায় চার শতাব্দী টিকে ছিল। এরও আগে সপ্তম শতকের বঙ্গের কর্ণসুবর্ণে শশাঙ্ক রাজত্ব করেছেন। তাঁর কথা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং লিখে গেছেন। পাল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ে সেন রাজারা প্রায় ১০০ বছর এই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। ইতিহাস স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের কথা। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে রচিত বৌদ্ধচর্যা ও দোঁহা গানে বাংলা ভাষার আদি রূপের পরিচয় পাওয়া গেলেও তা যথার্থ পূর্ণতা পেয়ে বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে সুলতানী আমলে। আমলটা হলো হোসেন শাহ, নসরত শাহর আমল। মোঘল আমলেও জনপদের ভাষা, সাধারণ বাঙালীর মুখের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু কোন আমলেই অর্থাৎ পাল আমল থেকে মোঘল আমলের শেষ অব্দিÑ সিরাজদৌল্লা বা মির কাশিম পর্যন্তÑ বাংলা সরকারী ভাষা ছিল না, জনগণের ভাষা হলেও। বাংলা-রাষ্ট্রও জনগণের ছিল না। প্রায় হাজার বছর ধরে বঙ্গভূমিতে বিভিন্ন রাজ্য থাকলেও এবং সেই সব রাজ্যে বিভিন্ন রাজা, সুলতান, সুবেদার বা নবাব থাকলেও জনগণ কোনদিন দেশটির অধিপতি হতে পারেনিÑ দেশের অধিকার পায়নি। রাজ্য ছিল রাজাকেন্দ্রিক। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও তা-ই ছিল। দেশ জনগণের ছিল না, দেশের উপর জনগণের অধিকারও ছিল না। ১৯৭১ সালেই বাঙালী তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম নিজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যে রাষ্ট্রে ঘোষিত হয় রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস জনগণ, অন্য কেউ নয় (ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে যেমন ফরাসী জনগণ ফ্রান্স বা ফরাসী রাষ্ট্রের অধিকার পেয়েছিল)। বাঙালীর কোনদিন কোন নিজস্ব সংবিধান ছিল না, যে সাংবিধানকে সে নিজের বলে দাবি করতে পারে। ১৯৭১ সালে অচিন্ত্যনীয় বিশাল এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামÑ যে সংগ্রামে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হয়েছিলেন এবং ৩ লাখ মা-জায়া-কন্যা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়েই গণবাঙালীর প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বা জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। জনগণের এই স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করেছিলেন এই রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১০ লাখ মানুষের সামনে ‘মানুষের স্বাধীনতার’ এমন ঘোষণা ইতিহাসে নেই; সে কারণেও এটি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। সেদিন তিনি বলেছিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনগণের যে মুক্তি অর্থাৎ প্রকৃত-স্বাধীনতা তিনি চেয়েছিলেন সেই স্বপ্নকেই তিনি রূপ দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশের সংবিধানে। এই সংবিধান উত্থাপনের সময় তিনি ৭ মার্চের সমতুল্য না হলেও তার প্রায় কাছাকাছি আর একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, এই সংবিধানই বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের প্রথম সংবিধান। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জনতার শাসনতন্ত্রে কোন কিছু লেখা হয় না ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থকÑ শহীদের রক্তদান সার্থক।’ ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালীর জন্য কেবলমাত্র স্বাধীনতা চাননি, মুক্তিও চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বরের ভাষণে তিনি এই মুক্তি কি তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, এই সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ : বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, যে গণতন্ত্র কেবলমাত্র শোষকদের স্বার্থ রক্ষা করে, সে-গণতন্ত্রে তিনি বিশ্বাস করেন না, তিনি চান ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। আধুনিক দর্শনের অন্যতম স্রষ্টা হেগেল বলেছেন, ‘বিশ্ব ইতিহাস হলো স্বাধীনতার অগ্রগতির ইতিহাস।’ হেগেল এই স্বাধীনতাকে দেখেছিলেন ঊহষরমযঃবহসবহঃ দর্শন ও ফরাসী বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসেবে। ইতিহাসের দর্শনের ব্যাখ্যায় তাঁর বক্তব্য হলো, ইতিহাসে কোন জাতি কতটুকু অগ্রসর তা নির্ভর করে বা বোঝা যায় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গণমানুষের স্বাধীনতা বা মুক্তি কতটুকু এগিয়েছে তার উপর। ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল শত শত শতাব্দীর রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের শৃঙ্খল ছিন্ন করে। এই বিপ্লবের অব্যবহিত পরে ১৭৮৯-এর আগস্টে ঘোষিত হয়েছিলÑ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ৎরমযঃং ড়ভ সধহ ধহফ পরঃরুবহং। ফরাসী বিপ্লবের এই মানবাধিকারের ঘোষণার মধ্যেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল যে, বিশ্বের সব মানুষ সমান। ফরাসী বিপ্লবের স্লোগান ছিল ‘ঊয়ঁধষরঃু, ঋৎধঃবৎহরঃু ধহফ খরনবৎঃু’ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ফরাসী বিপ্লব যেসব ঊহষরমযঃবহসবহঃ দার্শনিকদের বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপিত হয়েছিল তাঁদের অন্যতম রুশো। তিনি লিখেছিলেন, অষষ সবহ ধৎব নড়ৎহ ভৎবব, নঁঃ যব রং রহ পযধরহং বাবৎু যিবৎব- সব মানুষই জন্মের সময় স্বাধীন, কিন্তু তারপর থেকে সে শৃঙ্খলিত হতে থাকে। এই শৃঙ্খলই হলো পরাধীনতার শৃঙ্খল, মুক্তিহীনতা, যে মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। এই মুক্তিহীনতা কেবলমাত্র রাজনৈতিক অধীনতা নয়, এই মুক্তিহীনতা নিজেকে মানবিক-সত্তায় পূর্ণতা দেয়ার অক্ষমতা। জন্মের সময় একটি শিশু অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু সে যদি দাস হয়ে জন্মায়, দরিদ্রের ঘরে জন্মায়, রাস্তায় জন্মায় বা বস্তিতে জন্মায় তা’হলে তার পক্ষে নিজের মানবিক সত্তার সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। হেগেল বলেছেন, প্রত্যেক বস্তুর যে অন্তর্লীন সত্তা রয়েছে বা ঊংংবহপব রয়েছে তা মূর্ত করার মধ্যেই রয়েছে তার যৌক্তিক পরিণতি। একটি বটগাছের বীজ যদি মহীরুহে পরিণত হতে না পারে, ছোট গাছ থেকে যায়, তা’হলে সে তার অন্তর্লীন সত্তা বা ঊংংবহপব কে পূর্ণতা দিতে পারল না, সেটি যথার্থ বটগাছ হলো না। ভাল মাটি বা পরিবেশ পেলে একটি বটগাছের বীজ মহীরুহে পরিণত হবে। বীজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার, না-বীজ-অঙ্কুর ও না-অঙ্কুর-ফুলÑ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বীজটি মহীরুহে বা গাছে পূর্ণতা পেল। কিন্তু এই পূর্ণতা প্রাপ্তি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত তাড়নার ফল। এখানে কোন সচেতন প্রয়াস নেই, তাই গাছটি ইতিহাসের যথার্থ বিষয় নয়, ংঁনলবপঃ নয়। মানুষই ইতিহাসের যথার্থ বিষয়। কারণ, মানুষ ইতিহাস ও প্রকৃতির মধ্য দিয়ে নিজের যুক্তির শক্তিতে, নিজের সব সম্ভাবনাকে বিকশিত করে। সত্তার সব সম্ভাবনা (ঊংংবহপব)-কে যৌক্তিক পরিণতি দেয়ার জন্য মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। ঘটনার দাস থাকলে মানুষ কখনো নিজের সম্ভাবনা বা ঊংংবহপব কে পূর্ণতা দিতে পারে না। আমরা যখন ব্রিটিশ বা পাকিস্তানের গোলাম ছিলাম তখন আমাদের মানুষ হিসেবে যে সম্ভাবনা বা ঊংংবহপব তাকে পূর্ণতা দিতে পারিনি। কোন মানুষকে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে হলে, ঘটনার বন্ধন তাকে ছিন্ন করতে হবে, দাসত্ব ছিন্ন করতে হবে। কোন মানুষ যখন ‘ঘটনা’র অথবা বাস্তবতার অধীন হিসেবে দাস, ক্রীতদাস, ভূমিদাস অথবা শ্রমিক হিসেবে অমানবিক শ্রম দিতে বাধ্য, কেবল বেঁচে থাকার জন্য; যখন সে মাথার উপরে আবাসনের আশ্রয় পায় না, রোগে চিকিৎসা পায় না, অক্ষরজ্ঞান অর্জন করে না, শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলো পায় না, অবকাশ ও সুস্থ বিনোদনের অধিকার পায় না, তখন তার ‘জীব’-সত্তা থাকলেও সে-তো প্রকৃত অর্থে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেনি। ‘মানুষ’-অস্তিত্ব অর্থাৎ প্রকৃত ‘মানুষ’ হতে হলে তাকে সচেতনভাবে সংগ্রাম করে এই ‘বাস্তবে’র অধীনতা থেকে স্বাধীন হতে হবে, মুক্তি পেতে হবে। হেগেল এই ‘স্বাধীনতা’র কথা বলেছেন; বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’-এ এই মুক্তির কথাই বলেছেন। মার্কসের মতেও, শোষিত, নিরন্ন-বিত্তহীন মানুষ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও সে কখনোই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়, মুক্ত নয়। অসীম বীরত্ব ও শোণিত-স্রোতের মধ্য দিয়ে বাঙালী যে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে তার সংবিধানের মূল নীতিতে তাকে ‘মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা’ দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে রাষ্ট্র ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধনের মাধ্যমে তার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত জীবন মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে তার জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে; তার জন্য যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন, অবকাশ ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করবে’। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের যে চারটি মূল স্তম্ভÑ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকেই ‘সংবিধান’ এবং জাতীয় জীবন থেকে অপসৃত করা হয়নি, এক ধরনের লুম্পেন ঋণখেলাপী বুর্জোয়া উন্নয়ন-পথ অনুসরণ করে প্রতিটি বাঙালীকে, নাগরিককে যে মুক্তির, এক কথায় দারিদ্র্য-মুক্তি ও ঋদ্ধ জীবনের আশ্বাস বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তা ঝেড়ে ফেলা হয়। এমনকি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও এক পর্যায়ে পরিত্যক্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি গত চার দশকে এক দশকের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তা নিয়ে বাঙালী আজ বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে আসীন। গোল্ডম্যান স্যাক্স বাংলাদেশকে বিশ্বের ১১টি উদীয়মান অর্থনীতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আই.এম.এফের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতি। যদি বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার বজায় থাকে ব্রিটেনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকার হিসাব মতে, ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি উন্নত দেশগুলোর সমৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে। ‘মানব উন্নয়নের’ অনেক সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি পাকিস্তানের থেকে প্রায় সবক্ষেত্রে, এমনকি ভারত থেকেও অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ১৯৭১ সালে ছিল মাত্র এক কোটি টন, কারণ পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের কাছে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি ছিল চরম অবহেলার ক্ষেত্র, বাংলাদেশের জমি উর্বরতায় অনন্যসাধারণ হলেও। বাংলাদেশের কৃষির চাষযোগ্য জমির পরিমাণ আজ কমে গেলেও, উৎপাদন ৩ কোটি ৮০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। মাছ ও সবজির উৎপাদনেও বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর। বৃদ্ধদের জন্য বয়স্কভাতা প্রবর্তন ও বাস্তুহীন মানুষের জন্য ঘরে ফেরা কর্মসূচী, প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনÑ হাসিনা সরকারের এদেশের মানুষের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আনার প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। মাত্র ছ’বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন চার গুণ বৃদ্ধি করে লোডশেডিংয়ের অবসান ঘটিয়ে অন্ধকার গৃহগুলোকে আবার আলোকিত করা এবং বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হওয়া অনেক শিল্পে আবার প্রাণ-সঞ্চারও বর্তমান সরকারের এক বড় অর্জন। শিক্ষার ক্ষেত্রেওÑ বিশেষত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সরকারের অবদান অকল্পনীয়। বছরের প্রথমেই কয়েক কোটি (এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কোটি, সব বছর যোগ করে) বই স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দৃষ্টান্ত বিশ্ব-ইতিহাসেই অনন্য। কিছুদিন আগেও জি.ডি.পি-তে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশের নিচে, আজ তা ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ২৭ বিলিয়নের সীমা ছাড়িয়েছে এ মাসেই, যা এই সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগে মাত্র ছ’ বিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এতটাই শক্তিশালী যে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প নিজ অর্থে (বিশ্ব ব্যাংকের ঋণদানকে প্রত্যাখ্যান করে) সম্পন্ন করতে সরকার দ্বিধান্বিত নয়। বাংলাদেশের এতসব বৃহৎ অর্জন সত্ত্বেও এটা তো আজ দৃশ্যমান, বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে যে মুক্তির, যে ঋদ্ধ জীবনের আশ্বাস দিয়েছিলেন তা আজও অপ্রাপ্ত, আজও বহুদূরে। কারণ, যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ হচ্ছে তা যথার্থ অর্থে সাম্যভিত্তিক নয়। কতিপয় লোক জনগণের সম্পদ, ব্যাংক ইত্যাদি লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র না হলেও সে অসাম্যের দুষ্টচক্রে বেশ কিছুটা বন্দী, আবদ্ধ। নিম্ন-বিত্তের কারণে প্রকৃত-শিক্ষায় প্রবেশাধিকার না পাওয়া এবং সে কারণে নিম্নবিত্তের বেড়া ভাঙতে অক্ষমতা আমাদের জনজীবনে প্রকট। এরকম এক দুষ্টচক্রে আমরা কয়েক দশক নিমজ্জিত থাকতে পারি। মনে রাখা দরকার, ল্যাটিন আমেরিকা ঊনবিংশ, বিংশ শতাব্দী কাটিয়েছে এমন এক দুষ্টচক্রে। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মানুষকে সবকিছু এনে দেয় না, মানুষ করে তোলে না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে চীন এবং ভারত ছিল বিশ্বের সর্বাধিক শিল্পসমৃদ্ধ দেশ। ১৭৫০ সালে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ শিল্প সামগ্রী চীন ও ২৫ শতাংশ ভারত উৎপাদন করত। কিন্তু কুসংস্কার, চিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের তুলনায় বিরাটভাবে অনগ্রসরতা মাত্র ৬০ বছরের মধ্যে বিশ্বে এই দু’টি দেশকে বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করেছিল। চীনের শিল্প উৎপাদন নেমে এসেছিল বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের ৩ শতাংশে, ভারতের ক্ষেত্রে তা হয়েছিল ১ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে, মুক্তির স্বপ্নকে রূপ দিতে হলে, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে হবে সাম্যভিত্তিক, সবাইকে নিয়ে। তৈরি করতে হবে যুক্তি-নির্ভর, কুসংস্কারমুক্ত, জ্ঞান-ভিত্তিক মানবিক সমাজ। এটাই হোক আজকের তরুণ সমাজের অঙ্গীকার।
×