ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মফিদুল হক

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস এবং গণহত্যার বিচার

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব  জুরিস্টস এবং গণহত্যার বিচার

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইড বা গণহত্যা বিশ্বের দেশে দেশে অগণিত মানুষকে বেদনার্ত ও শিহরিত করলেও জাতিসংঘ কিংবা তদীয় বিভিন্ন সংস্থা অথবা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ সংগঠনসমূহকে বিশেষ সক্রিয় করতে পারেনি। বিচলিত তারা হয়ত হয়েছিল তবে সক্রিয় হওয়ার পথ খুঁজে পায়নি, কিংবা বলা যায় তেমন পথানুসন্ধানও বিশেষ করেনি। পথ খুঁজে ফিরলে দিশা যে-কিছু মেলে, সফলতা না এলেও তেমন চেষ্টার যে একটা মূল্য থেকে যায়, তার উদাহরণ তৈরি করেছিল জেনেভাভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস বা আইসিজে। আইসিজের নাম বেশ রাশভারি, তবে স্মরণ রাখা দরকার এটা জাতিসংঘের অঙ্গ-সংগঠন নয়, জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক সংস্থা, মূলত গণতান্ত্রিক আইনজীবীদের ফোরাম যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে চিন্তা ও কর্মে সমর্পিত। আইসিজে সংগঠন হিসেবে ছিল সম্মানিত এবং বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুরতা ঘটছে সে-সম্পর্কে অবহিত। ফলে আইসিজে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেনি, কিন্তু জাতিসংঘ স্বীকৃত সংগঠন হিসেবে বিশ্বসভায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের রীতিনীতি মান্য করেই তাদের চলতে হয়েছে। তাই আইসিজের কর্মপরিধি ছিল সঙ্কুচিত। তো আইসিজি চেয়েছিল বাংলাদেশের সংঘাত ও নৃশংসতা তলিয়ে দেখার জন্য তারা একটি দল প্রেরণ করবে উপমহাদেশে। সেজন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা তারা পেয়েছিল, ভারতের অনুমোদনও লাভ করেছিল, কিন্তু পাকিস্তান সম্মত না হওয়ায় সেই দল আর উপমহাদেশে পা রাখতে পারেনি। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত এগিয়ে যায় পরিণতির দিকে। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে জš§ নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বাংলাদেশের অভ্যুদয় উপমহাদেশে যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটায়, সেসঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে রক্তক্ষয় ও সংঘাত বন্ধ হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের পর দেশব্যাপী সরকারের নিয়ন্ত্রণও পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়। একে একে বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু“করে এবং বিবিধ সমস্যা সত্ত্বেও শুরু হয় রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অভিযাত্রা। এই পরিস্থিতিতে সঙ্কট বিষয়ে আইসিজে দাপ্তরিক পর্যালোচনা রিপোর্ট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের জুন মাসে জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয় রিপোর্ট ‘দি ইভেন্ট্স্ ইন ইস্ট পাকিস্তান : ১৯৭১-এ লিগাল স্টাডি’। ৯৯ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা হয়েছে পাকিস্তানের উদ্ভব, আন্ত-নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের সংগ্রামের বৈধতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার তাৎপর্য, পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস সামরিক অভিযান তথা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে কি করণীয় হতে পারে তার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। আইসিজের রিপোর্টের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে, তবে এটাই ছিল প্রথম আইনগত বিশ্লেষণ যেখানে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার বিচারের পথানুসন্ধান করা হয়েছে। আইসিজের রিপোর্টে বলা হয়, ‘জাতীয় আইনে জাতীয় ট্রাইব্যুনালে এমনি বিচার করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, তবে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক আইনে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করার পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। যেমনটা প্রচারিত হয়েছে উর্ধতন পাকিস্তানী কর্মকর্তা ও অফিসারদের বিচার করা হবে, সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল যদি আন্তর্জাতিক চরিত্রের হয় তবে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমতকে সন্তুষ্ট করা সহজ হবে।’ নুরেমবার্গে গঠিত আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা সবাই বিজয়ী জাতির প্রতিনিধি ছিল, এ-কারণে পরবর্তী সমালোচনার উল্লেখ করে আইসিজে মতপ্রকাশ করেছিল যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক নিরপেক্ষ দেশ থেকে আগত হলে ভাল হয়। আইসিজে আরও মনে করেছিল, জাতিসংঘের উদ্যোগে এমনি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম, তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তেমন উদ্যোগ গ্রহণের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও যে জাতিসংঘ দ্বারা গঠিত ট্রাইব্যুনালকে স্বাগত জানাবে, রিপোর্টে তা উল্লেখ করে বলা হয় যে, কোন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হলে তা বাংলাদেশ সরকারকেই করতে হবে। রিপোর্টে বলা হয়, ‘যদি আমরা ধরে নিই যে বাংলাদেশের আইনে এমন এক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো, সেক্ষেত্রে অপরাধীদের বাংলাদেশের নিজস্ব আইন ও আন্তর্জাতিক আইন উভয় ধারায় অভিযুক্ত না করার কোন কারণ থাকতে পারে না।’ জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী অপরাধের ধরন বিচার করে আইসিজে অভিমত প্রদান করে যে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর যে আক্রমণ তা অবশ্যই জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে, তবে বাঙালী জাতি-গোষ্ঠীর ওপর যে আঘাত সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ তারা করেন। এই রিপোর্ট প্রণয়নের পর আইসিজে মহাসচিব একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেন, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পথ ও পদ্ধতি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে থাকে। ২ জুলাই ১৯৭২ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটায় এবং অধিকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে উভয় দেশের সৈন্যদের আন্তর্জাতিক সীমানায় স্ব-স্ব অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। তবে বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী নব্বই সহস্রাধিক যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পণ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত সিমলায় গৃহীত হয়নি। যেহেতু যুদ্ধবন্দীদের ওপর বাংলাদেশেরও এখতিয়ার রয়েছে তাই ভারত মতপ্রকাশ করে যে, বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছাড়া এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে না বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত থাকুক। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পণের সঙ্গে যুক্ত করে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন। এক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলেও অন্তরালে চলছিল এক আলোচনা জাতিসংঘের পৌরহিত্যে। ৯৫,০০০ পাক-যুদ্ধবন্দীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন জাতিসংঘের বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সংঘাত শেষে বন্দী-বিনিময় অবশ্যপালনীয় শর্ত। এই শর্তপূরণের সঙ্গে এ-ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রশ্ন। তাই জাতিসংঘ পরিচালিত অন্তরালের আলোচনায় যুদ্ধাপরাধের বিচার ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিচারের ন্যায্যতা পাকিস্তান অস্বীকার করেনি, তবে বিচার করতে হলে তারাই এর উদ্যোগ নেবে এমনটা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। আলোচনার একপর্যায়ে বিচারের রূপরেখা প্রণয়নের তাগিদ দেখা দেয় এবং জাতিসংঘের পক্ষে আইসিজে এই দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশও ঘোষণা করে, তারা চায় ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বাদবাকি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত যাওয়া সম্পর্কে আলোচনা চলতে পারে। জাতিসংঘের দূতের মাধ্যমে আলোচনা অবশ্য প্রকাশ্যে পরিচালিত হয়নি, গোপন এই আলোচনার দলিল-দস্তাবেজ সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক অবমুক্ত হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন সম্পর্কে আইসিজের সবিস্তার প্রস্তাবনা দেখতে পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে যা জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। এই উদ্যোগ অবশ্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল অচিরেই, কেননা পাকিস্তান তা মানতে ঘোর আপত্তি জানায়। তবে আইসিজের এমনি তৎপরতার গুরুত্ব তাতে ক্ষুণœ হয় না। আমরা এখানে আইসিজের তৎপরতার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করছি। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আইসিজে ট্রাইব্যুনাল গঠন বিষয়ে পর্যালোচনা পেশ করার সময় এ-নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল না। অন্যদিকে একই সময়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কোন লক্ষণ না দেখে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একলা চলার, সংসদে পেশ করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিল। ২৫ জুলাই ১৯৭৩ আইসিজের মহাসচিব নিয়াল ম্যাকডেরমট এক পত্র প্রেরণ করেন জাতিসংঘের কাছে। তিনি লেখেন : “প্রিয় মহাসচিব, প্রিন্স সদরুদ্দিনের কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছি যে গত রবিবার প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর কাছে আমি যে প্রস্তাব করেছিলাম তার বিশদকরণ আপনি প্রত্যাশা করছেন। ১৯৫ জন পাক যুদ্ধবন্দীর বিচারের জন্য প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের যে পদক্ষেপ তা হুমকির মুখোমুখি পড়েছে ঢাকায় গৃহীত ব্যবস্থা দ্বারা। আমাদের প্রস্তাবনার লক্ষ্য হচ্ছে বিচারের এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন যা পাকিস্তানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে আটক প্রায় ৫ লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ নাজুক হওয়া থেকে তাদের উদ্ধার করবে।” একই সময়ে বাংলাদেশের সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) বিল। সেটা জেনে নিয়াল ম্যাকডেরমট লিখেছেন, “আমরা জানতে পেরেছি গত রবিবার বাংলাদেশ পার্লামেন্টে এক বিল উত্থাপন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের ঢাকায় বিচার করার জন্য তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল’ গঠনকল্পে। একদিকে এর ফলে নতুন জটিলতা তৈরি হলো, যা-কিছু ঘটুক না কেন, নিজস্বভাবে বিচারে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সংকল্প এখানে প্রকাশ পেয়েছে।” নিয়াল ম্যাকডেরমট আরও মনে করেছেন যে, এখানে নতুন সুযোগও তৈরি হলো, কারণ বিশ্ব জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্য সত্যিকারভাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর (মুজিবের) সঙ্গে আলোচনার পথ উন্মুক্ত হলো। বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “সবকিছুর পরও তিনি বলেছেন যে, বিচার-অনুষ্ঠানে তাঁর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষদের যে চরম অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে তা বিশ্ববাসীকে জানানো।” বাংলাদেশের সার্বভৌম সংসদে এই বিল গৃহীত হয়ে এ্যাক্ট বা আইন হয়ে উঠেছিল ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই। বিলটি গৃহীত হওয়ার সময় অপরাধ যে গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল এবং বিচার যে মানব সভ্যতার পক্ষে করা প্রয়োজন, তা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী শ্রীমনোরঞ্জন ধর তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আজকে বাংলাদেশে যেসব যুদ্ধাপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে যদি তারা বিনা বিচারে, বিনা শাস্তিতে রেহাই পেয়ে যান, তাহলে সমস্ত সভ্য জাতির চোখে আমরা পরিহাসের পাত্র হব এবং আমরা অত্যন্ত কদর্য নজির স্থাপন করব। এই বিচার করা আমাদের পরমতম কর্তব্য। বিশ্বসভ্যতার প্রতি মর্যাদা দেখাবার জন্য, মানবসভ্যতা মানবশান্তির প্রতি মর্যাদা দেখাবার জন্য এটা আমাদের পরম কর্তব্য যে, আজকে আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে।” এই জুলাই মাসেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রেরিত পত্রে নিয়াল ম্যাকডেরমট আইসিজের প্রস্তাবনা বিশদাকারে মেলে ধরেন। তিনি ছয়টি প্রশ্ন উত্থাপন করে একে একে এসব বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রশ্নগুলো ছিল : “১. ট্রাইব্যুনাল কারা গঠন করবে, বিচারক নিয়োগ দেবে কারা? ২. ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার ও কর্ম-পদ্ধতি কী হবে? ৩. ফোরম কাদের নিয়ে গঠিত হবে? ৪. প্রসিকিউশনের কর্তৃত্ব কাদের ওপর ন্যস্ত হবে? ৫. কী ধরনের শাস্তিদানের অধিকার ট্রাইব্যুনালের থাকবে? ৬. শাস্তি কার্যকর করবে কারা?” আইসিজের সবিস্তার প্রস্তাবনা জাতিসংঘ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল এবং এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ব্রায়ান উরকুহার্ট তা পাঠিয়েছিলেন লিগ্যাল ডিভিশনে আইনগত পরামর্শ লাভের জন্য। খুব দ্রুতই জবাব আসে লিগ্যাল এ্যাফেয়ার্স অফিসের পরিচালক ব্লেইন সেøানের কাছ থেকে। ১ আগস্ট ১৯৭৩ প্রেরিত পত্রে আইনগত খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রদত্ত অভিমতের সঙ্গে উল্লেখ করা হয় : “পৃষ্ঠা তিনে প্রদত্ত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমিও একমত যে, পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ-এ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের কৃত অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনে মূল সমস্যা হচ্ছেÑ রাজনৈতিক এবং এই সমস্যা মোচনের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। অন্যদিকে, আমার উপলব্ধি যদি ভুল প্রমাণিত হয় তবে এমনি ট্রাইব্যুনাল গঠনে উপযুক্ত আইনী ফর্মুলা বের করা কঠিন হবে না।” আমাদের মনে রাখতে হবে গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ে ওয়াকেফহাল ব্যক্তিরা পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজনে আইনগত নানা উপায় দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু শঙ্কা ছিল রাজনৈতিক মহল ও ক্ষমতাধর নেতৃত্ব নিয়ে, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এই বিচার অনুষ্ঠান সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটলো, শঙ্কাই বিজয়ী হলো, তবে তারপরেও আইসিজে এবং জাতিসংঘের তৎপরতা বহন করে গুরুত্ব এবং গণহত্যার বিচারে মানবসমাজের প্রচেষ্টার তা অংশ হয়ে আছে। ১৯৫ পাক-যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের এদেশীয় দোসর, যাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, গণহত্যার মতো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা, তাদের বিচারের পথ খুঁজে ফিরছিল বাংলাদেশ। এহেন অপরাধের বিচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিল, যেহেতু বাংলাদেশ ছিল অপরাধের শিকার দেশ, ভিকটিম নেশন, এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই বিচার অনুষ্ঠানের দাবি সর্বদা করে আসছিল। এই দাবির বাস্তবরূপ কী হতে পারে সেটা নির্ধারণে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের অবস্থান তাই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের জন্য সংসদে বিল উত্থাপন করল তখন নিয়াল ম্যাকডেরমট একদিক দিয়ে স্বস্তি পেয়েছিলেন যে, দেশীয় আইনে নয়, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এই বিচার করতে চাইছে বাংলাদেশ। তবে প্রস্তাবিত আইনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল’ কথাটির তাৎপর্য বুঝতে তাঁরও ভুল হয়েছিল, এখানে ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক বলা হয়নি, অপরাধকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল যে দেশীয় বিচারক প্যানেল নিয়ে গঠিত হবে, সেটা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত ছিল। হতে পারে সম্পূর্ণ আইনটি তখনও হাতে পাননি নিয়াল ম্যাকডেরমট, আর তাই এই ভুল তিনি করেছিলেন। তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বচ্ছ, এবং তিনি কামনা করছিলেন আন্তর্জাতিক বিচারকদের নিয়ে গঠিত আদালত, যেটা বাংলাদেশও শুরু থেকে দাবি করে আসছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমাগত ব্যর্থতার মুখে শেষাবধি জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। নিয়াল ম্যাকডেরমট ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আলোচনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচারের প্রয়োজনীয়তা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একাই যে-উদ্যোগ নিল সেটা আন্তর্জাতিক আদালত হলো না বলে আক্ষেপ করলেও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যে বিচারানুষ্ঠান করা হবে তা ভেবে স্বস্তিও বোধ করেছিলেন নিয়াল। তিনি লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান ও তার তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, যিনি এখন বিদেশ-মন্ত্রী, উভয়ের কাছে আমি বক্তব্য মেলে ধরি যে, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিচার ন্যায়সঙ্গত হয়েছে তা দেখার জন্য তাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি সহমত হই যে, যদি তারা বিচার করতে দৃঢ়সংকল্প হন তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হবে জেনোসাইড ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এবং সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনে তাদের অভিযুক্ত করতে হবে, কেননা ওই সময় এমত অপরাধ পাকিস্তানী আইনে (এবং সে-কারণে বাংলাদেশ আইনে) অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল না। এই যুক্তি তাঁরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন বিলে তাঁরা বিচার-ক্ষমতা অর্পণ করেছেন তথাকথিত আন্তর্জাতিক (তবে পরিপূর্ণভাবে জাতীয়) ট্রাইব্যুনালের ওপর যারা বিচার করবে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়।” জাতিসংঘের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার অগ্রগতির জন্য পাকিস্তানের সায় একান্ত জরুরি ছিল, জরুরি ছিল ক্ষমতাধর দেশসমূহের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন। এক্ষেত্রে দ্রুতই পাকিস্তানের সাফ জবাব মিলল ৩ আগস্ট ১৯৭৩ যখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আখন্দ এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ব্রায়ান উরকুয়ার্টের সঙ্গে দেখা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান। তবে লক্ষ করার বিষয় বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইসিজে কর্তৃক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন নিয়ে প্রবল আপত্তি জানালেও বিচারের প্রয়োজনীয়তা পাকিস্তান অস্বীকার করতে পারেনি। বরং পাকিস্তানী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পাকিস্তানে বিচার করা বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে এক ধরনের স্বীকৃতি তারা দিয়েছিল। পাকিস্তানের অসম্মতির মুখে জাতিসংঘ কিংবা আইসিজে কারও পক্ষে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়নি। এভাবে চোরাবালিতে তলিয়ে যায় বাংলাদেশে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়াস। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছিল একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচার করতে, তবে শেষ পর্যন্ত যে বাংলাদেশ সরকার নিজ উদ্যোগে নিজ জনগণের পক্ষে যে এই বিচার সূচনা ও পরিচালনা করতে পারল, সেটা অসাধারণ এক ঐতিহাসিক অর্জন।
×