ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নকশী কাঁথায় গাঁথা বিজয় ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

নকশী কাঁথায় গাঁথা বিজয় ঐতিহ্য

বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস তাঁদের লেখনীর ধারায় বিজয়ের একটা অস্তিত্বের লগ্ন আমরা পেয়েছি। চর্যা যুগ, মঙ্গল যুগ, আধুনিক যুগ সব যুগের সমাজ, সামাজিকতায়, মানুষ মানুষের মানসিকতায়, পরিবার পরিবারের প্রাধান্যতায় বিজয়ের একটা প্রচ্ছন্ন ছবি আমরা পাই। যুদ্ধ, লড়াই, সংগ্রাম শেষে বিজয়ের অনন্দ কিংবা বেদনার ধারাপাত তৈরি হয়। আমরা আদি অনাদিকাল থেকেই সে সব চিত্র জেনে এসেছি। পড়াশুনার ভেতর দিয়ে সেই জানা অনেক বেশি যুক্তিনির্ভর করার চেষ্টা করেছি। মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানী আমলÑসব আমলেই মানুষ মানুষের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যেই বিভিন্ন কলাকৌশলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে। জয়-পরাজয় থেকেছে ফলাফল ছুঁয়ে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মধ্যে কলহ, বিদ্রোহ, আনন্দ, আতিশয্য সবই বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমাদের সকলের জানা আছে, ব্রিটিশের গোলামি, পাকিস্তানের গোলামি সয়ে সয়ে এক সময় নিদারুণ প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ, পরাধীনতার শিকল ছেঁড়ার যুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব অর্জনের যুদ্ধ, বাঙালীর স্বাধিকার অর্জনের যুদ্ধ। মাতৃভাষার গৌরব অর্জনের যুদ্ধÑ সবই বিধৃত হয়েছে। এর বিস্তর আলোকমালায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকার অবদানসহ বেশ কিছু দেশ সুনির্ধারিত পথে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর পাশে। যুগে যুগে কালে কালে এমন মহান নেতা খুব একটা পাওয়া যায় না। এই বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। এই বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী চিন্তাবিদ তিনি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণদানসহ স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনাপর্ব শুরু হয়েছিলÑ ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। আজকের বাংলাদেশের এই ভূখ- রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। হয়েছিল রক্তনদীর সূত্রপাত। জেলে-তাঁতি, কামার-কুমোর, মুটে-মজুর, গাঁয়ের চাষী, নায়ের মাঝি, ছাত্র-জনতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বর্বর পাকিস্তানীদের হাতে নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালীদের অসামান্য নিগ্রহ, যন্ত্রণা, অত্যাচার, অবিচার, জ্বালানো, পোড়ানো, নারীজাতির ওপর অকথ্য অত্যাচার, ধর্ষণ নিপীড়ন এবং অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ অনলে দেশ পুড়ে ছাড়খার হচ্ছিল। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী জাতিÑ সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। যুদ্ধের ট্রেনিং নিল। মুক্তিযুদ্ধ-ক্যাম্প গড়ে তুলল। নারী-মহিলা, মা-বোনেরা ছদ্মবেশে চুড়িওয়ালা সেজে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলা-বারুদ-রসদ, খাবার-দাবার ইত্যাদি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যেত। সে এক অদম্য সাহসের ভূমিকার কথা। মা-বোনেরা যারা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যেত তারা শত্রুর ক্যাম্পে আশ্রয় পেত। সেখানে পাচক হয়ে, অথবা ধর্ষণের শিকার হয়ে বেঁচে থাকতে হতো। ওরা বীরাঙ্গনা ওরা বীরমাতা। ওদের কেউ কেউ যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিয়েছে। তার সেই সব যুদ্ধ শিশুরা বড় হয়েছে। স্বাধীনতার সীমানাকে বেষ্টন করে রেখেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন করেছি। তারপর থেকে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে যাপিতজীবনে বহুবিধ চড়াই-উৎরাই অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এখন ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। তবে এই ২০১৫ সাল জাতির সময়কালে এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই বছরের জানুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্রের ভূমিকা রেখেছিল রাজাকার, আল বদর, আল শামস, যুদ্ধাপরাধী এবং বিএনপি একাকার হয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার করেছে। ঘর জ্বালিয়েছে, পেট্রোলবোমা মেরে নারী, পুরুষ, শিশুÑ সকলের জীবনকে আহত করেছে, নিহত করেছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন দুর্বিষহ করেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারেনি, পরীক্ষা দিতে পারেনি, সাধারণ মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেনিÑকারণ অবরোধ। রিক্সাওয়ালা, ঠ্যালাওয়ালা, দিনমজুর সুস্থির জীবনযাপন করতে পারেনি। কলে-কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে বিশেষভাবে যুদ্ধাপরাধী মোঃ কাদের মোল্লাহ এবং মোঃ কামারুজ্জানের বিচারকার্য শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নজনকে জেরা করা হয়েছে সাক্ষী দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের। বিভিন্ন পর্যায়ে জেরা করার পর অপরাধীদের বিচারের রায়ের শুনানিÑ আপীলের শুনানি ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রমের পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধী মোঃ কাদের মোল্লা এবং এবছর এপ্রিলে মোঃ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। এটা বাঙালীর অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রশ্নে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন। এরপর একইভাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং মোঃ মুজাহিদের অপরাধ সাব্যস্ত করা, জেরা করাÑ আপীল করা ইত্যাদি ঘটনার পর ২০১৫ সালের নবেম্বর মাসে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। সরকারের নির্ভীক উচ্চারণ। অঙ্গীকার এবং সাহসিকতার পরিচায়ক হিসেবে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিজয়ের এ মাসে কিংবা এ মাসের কিছু আগে আমরা বীরমাতাদের স্বীকৃতি দিয়েছি। ওরা ওদের অহঙ্কারের জায়গা ফিরে পেয়েছে। আমরা গর্বিত হয়েছি সরকার কর্তৃক ওদের এই অভাবনীয় সম্মান প্রদানের ভূমিকাকে লক্ষ্য করে। বীরমাতাদের হাতে লাল-সবুজের পাতাকা, ওদের পায়ের নিচে স্বস্তির মাটি, ওদের জীবনযাপনে সুষ্ঠু সুন্দর অধ্যায় সূচিত হয়েছে। সংসারে, পরিবার, সমাজে, দেশে ওদের মূল্যায়ন হয়েছে, ওদের মর্যাদা বেড়েছে। জীবনযাপনের আকর্ষণ বেড়েছে। একটি পতাকা, একটু মাটি বীরমাতাদের অন্তরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। ‘বীরমাতা‘ চলচ্চিত্র তৈরি করা হচ্ছেÑ কবির কবিতা থেকে। গোটা বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় অগণিত মা-বোন বীরমাতার স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এটা আমাদের অর্জনÑ এটা বাঙালীর অর্জন। বিজয় একটি পবিত্র আমানত। বিজয় মানে আনন্দ, বিজয় মানে উৎসব, বিজয় মানে অন্তরের সাহস ও মনোবলের অধিকারের অর্জন। বিজয় আকাশে বাতাসে সাগরে পাহাড়ে সর্বত্র আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়া। আমরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের রেসকোর্সের ময়দানে নিয়াজির কোমরের বেল্ট এবং কাঁধের ব্যাজ খুলে দেয়ার দৃশ্য দেখেছি। জয় বাংলার উচ্চারণে মুখরিত ছিল সেদিনের চেতনা। মুক্তির চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা, লাল-সবুজ পতাকার উড্ডীন চেতনা। সমগ্র বাংলা দেশের ফুল-পাখি-লতা-পাতা এবং মেঘ-রোদ্দুরের খেলা নিয়ে মাতোয়ারা হয়েছিল। ঐতিহাসিক সে অর্জন সে বিজয় সমগ্র বাঙালীকে উজ্জীবিত করেছিল। উৎসাহিত করেছিল এবং হৃদয়ের গহীনে সুখের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শেষের দিনগুলোর পর বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর একটি বেদনার দিন হিসেবে আমরা চিহ্নিত করেছি। সারাটা বছর ধরে বাঙালী নিধন যজ্ঞ চালিয়েছে ওই পাকিস্তানী হানাদাররা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং যুদ্ধাপরাধীরা। দেশটাকে ওরা মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ সরকারী বাঙালী কর্মচারীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে চোখবেঁধে সারা বাংলার বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাদের পরিবারের কাছে কোন ঠিকানা হানাদাররা দেয়নি। কাক্সিক্ষত যুদ্ধ বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে দেশে যে হত্যাযজ্ঞের চিহ্ন রেখেছিল হানাদাররা তার বেদনা আমরা সয়ে নিয়েছি। ১৪ ডিসেম্বরকে বলেছি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরে সেই সব পরিবারের যে আর্তি ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় তাকে কিছুটা হলেও আনন্দ দেয়। শোক এবং সুখ, বেদনা এবং আনন্দ এই ডিসেম্বরের বিজয়ঘন মুহূর্তে আমাদের বুকে নস্টালজিয়ার জন্ম দেয়। এ বিজয় শাণিত সচেতন বিজয়Ñ তাই শোকের গাথাও নকশী কাঁথার মাঝে হৃদয়ের আনন্দের প্রলেপ দিয়ে যায়। দেশ আনন্দিত হয়Ñ পতাকা লাল-সবুজ ঘিরে চির উড্ডীন থাকে।
×