ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন স্কেলে ডিসেম্বরের বেতন, সঙ্গে বকেয়া ৫ মাসের অর্ধেক

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

নতুন স্কেলে ডিসেম্বরের বেতন, সঙ্গে বকেয়া ৫ মাসের অর্ধেক

এম শাহজাহান ॥ অষ্টম পে স্কেলে বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করায় খুশি সরকারী চাকরিজীবীরা। বহুল কাক্সিক্ষত গেজেট প্রকাশ হওয়ায় সরকারী চাকুরেদের বিজয় দিবসের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিজয়ের মাসের বেতন অষ্টম স্কেলে প্রদান করা হবে। এর সঙ্গে তারা জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া গত পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনের অর্ধেক পাবেন। ফলে জানুয়ারিতে দেশের ২১ লাখ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে বাড়তি টাকা যাচ্ছে। বাড়তি এ টাকা মূল্যস্ফীতির ওপর কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছে সরকার। বরং অষ্টম পে স্কেল বাস্তবায়ন হওয়ায় সরকারী চাকুরেদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অষ্টম পে স্কেল কার্যকরের মধ্যদিয়ে দেশের অর্থনীতি আরেক দফা চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। এদিকে, অষ্টম পে স্কেলে বেতন দ্বিগুণ বাড়ানো হলেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল নিয়ে বিতর্কের শেষ হচ্ছে না। এ পদ্ধতি বাতিল করে যে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে তাতে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন দশম গ্রেড থেকে শুরু করে নিচের দিকের কর্মকর্তারা। এ কারণে অর্থবিভাগের জারি করা নতুন বেতন কাঠামোর গেজেটের বিরুদ্ধে মামলাও করা হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিজীবীদের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতনকাঠামোর গেজেট জারি করা হয়েছে। বহুল আলোচিত টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ রেখেই জারি করা হয়েছে এ গেজেট। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদই দেয়া হয়েছে। এটি বাদ দেয়া হলেও সরকারী কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। বরং এ পদ্ধতির কথা এক সময় তারা ভুলে যাবেন। তিনি বলেন, যারা এ সুবিধা প্রত্যাশা করেন, তাদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এবং ১০ বছর পর একটি ও ১৬ বছর পর আরেকটি পদোন্নতি দেয়া হবে তাদের। ফলে এবারের বেতন কাঠামোর মাধ্যমে সরকারী চাকরিজীবীরা খুশিই হবেন। এছাড়া মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি জানান, জানুয়ারি থেকে অষ্টম পে স্কেলের টাকা কেনাকাটায় এলেও তাতে মূল্যস্ফীতি ঘটবে না। সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক ইতিবাচক ধারায় আছে। এছাড়া দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদন হচ্ছে, তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, এ পর্যন্ত যতগুলো নতুন বেতন কাঠামো দেয়া হয়েছে তার পরই নিত্যপণ্যের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তাই এবারও কিছু কিছু জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, নতুন বেতন কাঠামোর টাকা হাতে আসার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেনাকাটা বাড়বে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটি একটি ভাল মানের বেতন কাঠামো দেয়া হয়েছে। সরকারী চাকুরেদের বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতিও কমে আসবে। তিনি বলেন, দেশে এ মুহূর্তে খাদ্যপণ্যের কোন সঙ্কট নেই। তাই নতুন বেতন কাঠামোতে মূল্যস্ফীতির ওপরও তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। অষ্টম পে স্কেলে বেতন বাড়ল দ্বিগুণ ॥ অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী চলতি বছরে শুধু মূল বেতন পাবেন সরকারী চাকরিজীবীরা। গ্রেড-১-এর কর্মকর্তাদের মূল বেতন হলো ৭৮ হাজার টাকা নির্ধারিত, গ্রেড-২-এর ৬৬ হাজার টাকা, গ্রেড-৩-এর ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-৪-এর ৫০ হাজার টাকা, গ্রেড-৫-এর ৪৩ হাজার টাকা, গ্রেড-৬-এর ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-৭-এর ২৯ হাজার টাকা, গ্রেড-৮-এর ২৩ হাজার টাকা, গ্রেড-৯-এর ২২ হাজার টাকা, গ্রেড-১০-এর ১৬ হাজার টাকা, গ্রেড-১১-এর ১২ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-১২-এর ১১ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-১৩-এর ১১ হাজার টাকা, গ্রেড-১৪-এর ১০ হাজার ২০০ টাকা, গ্রেড-১৫-এর ৯ হাজার ৭০০ টাকা, গ্রেড-১৬-এর ৯ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-১৭-এর ৯ হাজার, গ্রেড-১৮-এর ৮ হাজার ৮০০ টাকা, গ্রেড-১৯-এর ৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং গ্রেড-২০-এর মূল বেতন হলো ৮ হাজার ২৫০ টাকা। এত দিন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মাচারীদের মূল বেতন কমবেশি নতুন কাঠামোর অর্ধেক ছিল। এই অষ্টম পে স্কেলে বিশটি গ্রেড ছাড়াও দুটি বিশেষ গ্রেড রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের মূল বেতন হবে ৮৬ হাজার টাকা এবং সিনিয়র সচিবদের বেতন হবে ৮২ হাজার টাকা। তিন বাহিনীর প্রধানেরা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের সমান বেতন পাবেন। আর জ্যেষ্ঠ সচিবের সমান বেতন পাবেন লে. জেনারেল ও সমপদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তারা। জাতীয় অধ্যাপকেরা জ্যেষ্ঠ সচিবদের সমান বেতন পাবেন। এত দিন সরকারী চাকরিজীবীরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন পেয়ে আসছেন। নতুন কাঠামো কার্যকর করতে চলতি বছরে সরকারী চাকরিজীবীদের জন্য অতিরিক্ত ১৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থমন্ত্রী আগেই ঘোষণা করেছেন, নতুন বেতনকাঠামো কার্যকর হবে গত ১ জুলাই থেকে। এবার গেজেটেও তাই প্রকাশ করা হয়েছে। চাকরিজীবীরা ডিসেম্বরের বেতন নতুন কাঠামোতে পাবেন। এর সঙ্গে তারা পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনের অর্ধেক পাবেন। বেতনের বাকি অর্ধেক দেয়া হবে তাদের জানুয়ারির বেতনের সঙ্গে। আর ভাতা দেয়া হবে ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে। এছাড়া সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ক্ষেত্রে নতুন বেতনকাঠামো প্রযোজ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা আগের মতোই থাকবে। আর এমপিওভুক্ত বেসরকারী শিক্ষকদের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেবে, এরপর অর্থবিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এদিকে, মন্ত্রিসভায় পাস হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রস্তাবিত বেতনকাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে তারা নমনীয় হন। নতুন বেতনকাঠামোতে তাদের সুযোগ-সুবিধাও কমানো হয়নি। সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাতিল ॥ বিদ্যমান সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বিলোপ করে গেজেটে বলা হয়েছে, কোন স্থায়ী কর্মচারী পদোন্নতি ছাড়া একই পদে ১০ বছর সন্তোষজনকভাবে চাকরি করলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একাদশ বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাবেন। আর কোন স্থায়ী কর্মচারী চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাওয়ার পর পরবর্তী ছয় বছর পদোন্নতি না পেলে তার চাকরি সন্তোষজনক হলে সপ্তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাবেন বলে গেজেটে বলা হয়েছে। এছাড়া গেজেট প্রকাশের আগের দিন অর্থাৎ গত ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব সরকারী কর্মচারী সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পেয়েছেন, তা বহাল থাকবে বলেও গেজেটে বলা হয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী, প্রতিবছরের ১ জুলাই একসঙ্গে সব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাড়বে। এছাড়া নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা পাবেন। সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাতিল হওয়ায় বৈষম্য বাড়বে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গ্রেডিং পদ্ধতিতে নিচের দিকের কর্মকর্তা-কর্মাচরীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শুধু তাই নয় ৯ম থেকে যারা নিচের গ্রেডে আছেন তারা আর্থিকভাবে লোকসানের শিকার হবেন। তিনি বলেন, এত বড় স্কেল দেয়ার পরও শুধু টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেয়ায় বর্তমান ৮৫ শতাংশ সরকারী চাকরিজীবী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। বেতন বাড়বে প্রতি বছরের ১ জুলাই ॥ প্রতিবছরের ১ জুলাই সবার জন্য একই সঙ্গে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে। এর মধ্যে ২০ থেকে ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ। পঞ্চম গ্রেডে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। ৩ ও ৪ নম্বর গ্রেডে প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশ। গ্রেড ২-এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ১ নম্বর গ্রেডে প্রবৃদ্ধি হবে না। এ হিসেবে কারও মূল বেতন ১০ হাজার টাকা হলে এক বছরে তার ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে ৫০০ টাকা। প্রথম বছর শেষে ওই ব্যক্তির প্রবৃদ্ধিসহ বেতন দাঁড়াবে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে প্রতিবছরই বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। অষ্টম পে স্কেল অনুযায়ী, সব কর্মচারী প্রতি মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা হারে চিকিৎসা ভাতা পাবেন। আজীবন পারিবারিক পেনশনভোগীরাও এ ভাতা পাবেন ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। তবে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী অবসরভোগীরা চিকিৎসা ভাতা পাবেন ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। সরকারী বাসায় যারা থাকেন, বর্তমানে মূল বেতনের ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ তাদের কাছ থেকে বাডতি ভাড়া কেটে নেয়া হয়। এ পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সরকারী চাকরিজীবী হলে যার নামে বাসা বরাদ্দ রয়েছে, তার বেতন থেকে বাড়তি ভাড়া কেটে নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন এই বেতনকাঠামো অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। তার আগে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেতন ও চাকরি কমিশন।
×