ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি নির্ভরতা থেকে শ্রমশক্তি;###;দ্রুত স্থানান্তরিত হচ্ছে শিল্প খাতে

কমছে বেকার॥ পরিকল্পিত অর্থনীতির সুফল

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

কমছে বেকার॥ পরিকল্পিত অর্থনীতির সুফল

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ আলতাফ হোসেন (৪০)। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে। লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেননি। সপ্তম শ্রেণী পাস করার পর বাবার সঙ্গে সংসারের কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তারপর নদী ভাঙ্গনে নিজস্ব জমি ও ভিটামাটি বিলীন হয়ে গেলে। দীর্ঘদিন বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ান। এক পর্যায় গ্রামে শুরু করেন দিনমজুরের কাজ। কিন্তু এ কাজ মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। অবশেষে প্রায় বছর পাঁচেক আগে চলে আসেন গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে। ক’দিন বেকার থাকার পর কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে যোগ দেন একটি পোশাক কারখানায়। বর্তমানে তিনি আয়রন সেকশনের সহকারী প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। বেতনও পাচ্ছেন ভাল। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে কোনাবাড়ীতেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন তিনি। ছেলে দুটোকে স্কুলে পড়াচ্ছে। গ্রামে বাবা-মার কাছেও প্রতিমাসে সাধ্যমতো টাকা পাঠান। এভাবেই কমছে বেকার সংখ্যা। সুফল মিলছে পরিকল্পিত অর্থনীতির। কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছে দেশের শ্রমশক্তি। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে বেকার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশে। সেই সঙ্গে কমছে দিনমজুরের সংখ্যাও। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপের ফলাফলে এ চিত্র উঠে এসেছে। এই জরিপে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছর তাদের বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে বেকারের সংখ্যা না বাড়লেও শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বর্তমানে সাড়ে চার কোটি মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে অবস্থান করছে। এর অধিকাংশই নারী। এ ছাড়া শিক্ষার্থী এবং পরিবারের কাজে সহায়তাকারী রয়েছে। প্রায় ৩ কোটি ৬১ লাখ নারী শ্রমশক্তির বাইরে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫ লাখ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই ছিল কৃষি সংস্থান সৃষ্টি। সেক্ষেত্রে কৃষি থেকে শ্রমশক্তি সরিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল। সেই প্রচেষ্টারই প্রতিফলন ঘটেছে বিবিএসের এই প্রতিবেদনে। তিনি জানান, দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে অগ্রসরমান যা অতীতের যে কোন প্রবৃদ্ধি প্রবণতা থেকে অনেক বেশি গতিময় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অতীতের সমস্ত অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে ও বিদেশে মিলে গড়ে ২০ দশমিক ০১ লাখ নাগরিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী বছরগুলোতে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে। এ জন্য সবকিছু বিবেচনা করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ২৯ লাখ কর্ম সংস্থানের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা শুধু কৃষি থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে শ্রমশক্তি বাড়ার লক্ষ্য নিয়েছে তা নয় এর সঙ্গে সেবা খাতে যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে সে বিষয়ে কৌশল নেয়া হয়েছে। মানুষের আয় বাড়াতে এবং বাজারভিত্তিক মজুরি উন্নয়নে নানা কৌশল নেয়া হয়েছে। আগামীতে আশা করছি এগুলোর সুফল আরও স্পষ্ট ছিল। তিনি জানান, এক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে হয়েছে। এর বাইরে বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, বাণিজ্য বড় হয়েছে এবং অর্থনীতির বহুমুখিতার কারণে বেকারের সংখ্যা তেমন বাড়েনি। বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিসাবে এ সংখ্যা ৯০ লাখ। ২০১০ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬ লাখ। আবার ঘরের কাজে সাহায্য করে ৯০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৭৩ লাখ মানুষের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের হিসাবে অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। ২০১৩ সালে করা এ জরিপের আগে ২০১০ সালের পরিসংখ্যানেও এ সংখ্যা একই ছিল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী জরিপটি করা হয়। কিন্তু এ ফলাফল এখনও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়নি। শীঘ্রই এটি প্রকাশ হবে বলে বিবিএস সূত্র জানিয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে, কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। এক দশক আগে অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিভিত্তিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ছিল। এক্ষেত্রে অকৃষি খাত বিশেষ করে উৎপাদন, সেবা এবং ব্যবসাই ভরসা। বর্তমানে ৫৫ শতাংশ মানুষ কৃষিবহির্ভূত খাতে নিয়োজিত। কর্মজীবী মানুষের মাসিক আয়ের একটি হিসাবও করেছে বিবিএস। এতে দেখা গেছে অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ মাসিক ভিত্তিতে বেতন পেয়ে থাকেন। এসব মানুষের গড় আয় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। তবে পেশার ভিন্নতায় আয়ের ধরনে পার্থক্য রয়েছে। শহরের ব্যবস্থাপকরা মাসে ২৩ হাজার ৮০০ টাকা, টেকনিশিয়ানরা ২০ হাজার ৪০০ টাকা এবং অন্যান্য পেশার মানুষ সাড়ে ১৪ হাজার টাকা আয় করেন। সর্বশেষ এ জরিপের সময় দেশে ১৫ বছরের ওপরে মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৬৩ লাখ। এদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা (যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে) প্রায় ২৬ লাখ। তিন বছর আগের জরিপেও এ সংখ্যা একই ছিল। তবে এ সময়ে বেকারের হার সাড়ে চার শতাংশ থেকে কমে চার দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বেকার নারী ও পুরুষের সংখ্যা সমান। ২০১০ সালের জরিপে পুরুষ বেকার ছিল অনেক বেশি। এক দশক আগে এ সংখ্যা ছিল ২০ লাখ। এ সময় শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে না বলে দেখা গেছে। জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ প্রসঙ্গে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা সচিব কানিজ ফাতেমা জনকণ্ঠকে বলেন, এটি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটুকু করলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা চাই পরিসংখ্যান ব্যুরোর যে কোন জরিপ স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্ভরশীল হোক। যাতে এ নিয়ে অহেতুক কোন প্রশ্ন উঠতে না পারে। বিবিএসের হিসাবে এক দশকে ১৪ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮১ লাখে। এর মধ্যে পুরুষ কর্মজীবী ৪ কোটি ১২ লাখ এবং নারী ১ কোটি ৬৮ লাখ। দ্রুত বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে শহরের মানুষ। ২০১০ সালে শহরে কর্মজীবী ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ। এটি ২০১৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখে। এ সময় গ্রামে কর্মজীবী বেড়েছে মাত্র দুই লাখ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতি বছর তিন থেকে চার লাখ মানুষ চাকরির সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। ফলে তারা নতুন শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও বেকারের সংখ্যা বাড়ছে না। তিনি বলেন, নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশ না বাড়াটা উদ্বেগজনক। এর পেছনে কোন সামাজিক কারণ আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের শ্রমশক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ এ জরিপে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনের তথ্য উঠে এসেছে। সরকারী নীতিনির্ধারণে প্রতিবেদনটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার বিষয়ে ড. শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশ ধীরগতিতে দৃঢ় ও স্থিতিশীল কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। যা মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হওয়ার অন্যতম পথ। পরিকল্পিত অর্থনীতির কাছে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষিক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। তার আগের চার বছরে কৃষি খাতে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে কৃষি খাতে অগ্রগতি হচ্ছে তবে যা হচ্ছে তা হলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে শিল্প খাত।
×