ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখনও বিপিএল ‘ঘোরে’ আচ্ছন্ন ক্রিকেটামোদিরা

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

এখনও বিপিএল ‘ঘোরে’ আচ্ছন্ন ক্রিকেটামোদিরা

মিথুন আশরাফ ॥ পৌষ মাস। শীতে আচ্ছন্ন পুরো দেশ। এমন মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল টি২০) ঘোরও যেন কাটছেই না। বিপিএলের তৃতীয় আসর শেষ হয়েছে মঙ্গলবার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। রানার্সআপ হয়েছে বরিশাল বুলস। দুইদিন চলে গেলেও দেশজুড়ে বিপিএল ‘ঘোর’ চলছেই। চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে বিপিএলের। যেখানে আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাগুলোই চায়ের টেবিলে, মুদির দোকানে, অফিস-আদালতে স্থান পাচ্ছে। সবার মুখে এখনও বিপিএলই। ফাইনাল ম্যাচটি যে জমজমাট হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ হয়েছে, শেষ বলে গিয়ে শিরোপা নির্ধারণ হয়েছে; সেটিই বিপিএলের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিসিবির পরিচালক শেখ সোহেল যে বলেছিলেন, ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হিট তো বিপিএল হিট।’ হিটই হয়েছে বিপিএল। সবার মুখে মুখে যে এখনও বিপিএল আছে, সেটিই ‘হিটে’র বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। সেই হিট হতে গিয়ে একেকটি রেকর্ডও হয়েছে। অর্জন মিলেছে। বিপিএলে যেমন আলোচিত ঘটনাও ঘটেছে। তেমনি সমালোচিত ঘটনাও কম নয়। আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে এবার বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কুমিল্লা। প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে ‘সাদামাটা’ একটি দলই শিরোপা জিতেছে। যেটি বিপিএলকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সেই দলটিকে আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টি২০ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। যিনি দ্বিতীয় ম্যাচেই ব্যাট হাতে আগেই নেমে যে অর্ধশতক করেছেন ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন, পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছেন, কুমিল্লার ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস সেখানেই বেড়ে গেছে। তাতে করে শিরোপাও জয় হয়েছে। অভিজ্ঞতার ছোঁয়া মিলেছে এবার বিপিএলে। বিশেষ করে অলক কাপালীর নামটি এখন সবার মুখে মুখে। ফাইনালে জিততে শেষ ওভারে ১৩ রানের দরকার ছিল। কাপালী ম্যাচ জিতিয়ে দেন। ২৮ বলে যে অপরাজিত ৩৯ রান করে বুঝিয়ে দেন অভিজ্ঞতা চাইলেই ফুরিয়ে যায় না, সেটিই কাপালীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এ ম্যাচটি যে শেষ বলে গিয়ে শেষ হয়েছে, তাতে টুর্নামেন্টের ৩৪ ম্যাচের মধ্যে ১৮ ম্যাচই শেষ ওভারে গিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে! ক্রিস গেইল যোগ হওয়ার আগে সাদামাটা দলই ছিল বরিশাল। সেই দলটিকে ফাইনালে তুলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ইএসপিএন-ক্রিকইনফো বিপিএলের সেরা একাদশের অধিনায়ক তো তাই মাহমুদুল্লাহকেই বানিয়েছে। ব্যাট-বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার তুখোড় নেতৃত্বগুণের ছোঁয়া মিলেছে। তাতে করে মাহমুদুল্লাহও বিপিএল দিয়ে যেন আলাদাভাবেই সবার মনে জায়গা করে নিয়েছেন। বিপিএলে এবার সর্বোচ্চ রানটি করেছে রংপুর রাইডার্স। চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে ১৮৮ রান করেছে। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে গিয়ে বিদায় নিয়েছে রংপুর। তবে এই দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবার সমালোচিতই হয়েছেন। ব্যাট-বল হাতে আগের দুই আসরের টুর্নামেন্ট সেরা হওয়া সাকিব, এবার বিশেষ কিছু করে দেখাতে পারেননি। আবার আম্পায়ারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এক ম্যাচ নিষিদ্ধও হয়েছেন। বরিশাল বুলস রানার্সআপ হয়েছে। তবে দলটি আবার লজ্জাও উপহার দিয়েছে। বিপিএলে এবার সর্বনিম্ন রানের অলআউট হওয়ার ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে। সিলেট সুপার স্টারসের বিপক্ষে ৫৮ রানে গুটিয়ে গেছে বরিশাল। চ্যাম্পিয়ন হওয়াই শুধু নয়, মাশরাফি যেমন টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কুমিল্লাকেও প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। তেমনি মাশরাফির নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় জয়টি (৭২ রানের জয়, প্রতিপক্ষ রংপুর) কুমিল্লাই পেয়েছে। সর্বোচ্চ রান করা কিংবা সবচেয়ে বেশি উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য দেশী ক্রিকেটারদের প্রাধান্য নেই। ঢাকা ডায়নামাইটসের শ্রীলঙ্কার তারকা ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা ৩৮.৭৭ গড়ে সর্বোচ্চ ৩৪৯ রান করেছেন। বল হাতে বরিশালের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলার কেভন কুপার সর্বোচ্চ ২২ উইকেট শিকার করেছেন। আবার এক ইনিংসে মাত্র ১৫ রান দিয়ে সর্বোচ্চ ৫ উইকেট শিকার করেছেন কুপার। বিপিএলে এবার একটিই শতক হয়েছে। সেটি বরিশালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান এভিন লুইস (১০১*) করেছেন। এটি এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানও হয়ে আছে এবার। তবে বল হাতে যে এবার বিপিএলের ‘আবিষ্কার’ কুমিল্লার আবু হায়দার রনি ঝলক দেখিয়েছেন। ২১ উইকেট নিয়েছেন, টি২০তে জাতীয় দলের জার্সি যেন তার জন্য উন্মুক্তই হয়ে গেল। এখন শুধু অপেক্ষা। ক্রিস গেইল বিপিএল খেলতে নামার আগে যে ‘সেঞ্চুরি’ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবার। তবে আগের দুই আসরে তিন সেঞ্চুরি করা, মাঝপথেই বিপিএল থেকে সরে যাওয়া এ ব্যাটসম্যান ৪ ম্যাচ খেলে সবচেয়ে বেশি ১২টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ফাইনালে শুরুতেই দুর্দান্ত ইনিংস খেলে কুমিল্লাকে জয়ের সামনে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ৫৩ রান করা ইমরুল কায়েসের। তবে সবচেয়ে বেশি ৩ ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ার রেকর্ডও তারই। আল-আমিন হোসেন যেন নিজেকে আরও উপরে নিয়ে গেছেন। এবার বিপিএলে একমাত্র হ্যাটট্রিকটি তারই। বরিশালের হয়ে খেলা আল-আমিন সিলেটের বিপক্ষে শুধু হ্যাটট্রিকই করেননি, দেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনিই। সেই আল-আমিনই মোহাম্মদ শহীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে গিয়ে জরিমানার মুখে পড়েছেন। এবার বিপিএলে চট্টগ্রামে ইমরুলকে ‘ল্যাং’ মেরে ফেলে দেয়ার সমালোচিত ঘটনা ঘটিয়েছেন চিটাগাং ভাইকিংসের তিলকারতেœ দিলশান। এই দলের তামিম ইকবাল মিরপুরে সিলেট সুপার স্টারসের মালিকপক্ষে কাছ থেকে ‘গাল’ খাওয়ার মতো ঘটনারও সম্মুখীন হয়েছেন। এ দুইজন মিলেই আবার সিলেটের বিপক্ষেই বিপিএলের সেরা জুটিটি (১৪০ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি) গড়েছেন। দুইজন মিলে উইকেটের দিক দিয়ে ১০ উইকেটে জিতে বিপিএলের সেরা জয়টিও চিটাগাংকে পাইয়ে দিয়েছেন। এবার বিপিএল খুবই ঘটনাবহুল হয়েছে। এর মধ্যে মাশরাফির অনুরোধে কুমিল্লার কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘ডাগআউটে’ ছিলেন না। ফ্লপ হওয়া থেকে শেষ মুহূর্তে ঝড়ো দুটি ইনিংস খেলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন সাব্বির রহমান রুম্মন। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ৭ ফুট ১ ইঞ্চির মোহাম্মদ ইরফান খেলেছেন বিপিএলে। মাশরাফির ‘ভিনগ্রহের প্রতিভা’ মুস্তাফিজুর রহমান শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনায় থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুশফিকুর রহীম থেকে নেতৃত্ব নিয়ে সিলেটকে বদলে ফেলেছিলেন শহীদ আফ্রিদি। হাফিজ-আমির যুদ্ধে আমিরের জয় হয়েছে। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে বাউন্ডারির কাছ থেকে সাব্বিরের ছক্কা হওয়া বলটি বাঁচিয়ে ‘জিমনেস্টের’ মধ্যে বিপিএলের সেরা ক্যাচ ধরেছেন রংপুরের ড্যারেন সামি। হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে উমর আকমলকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু রান করেন মাত্র ১! তিলকারতেœ দিলশানের ছয় বলে ছয় চার হাঁকান স্বদেশী দিলশান মুনাভিরা। চট্টগ্রামে চিটাগাং ভাইকিংস-বরিশাল বুলস ম্যাচকে নিয়ে ফিক্সিং সন্দেহও করা হয়। এ বিপিএল প্রমাণ করেছে দেশ নিরাপদ, এখানে ক্রিকেট খেলা নিরাপদ। বিদেশী ক্রিকেটাররা অনায়াসেই খেলে গেছেন। সেই সঙ্গে ক্রিস গেইল, কুমার সাঙ্গাকারা, শহীদ আফ্রিদি, মিসবাহ উল হক, দিলশানরাও বিপিএল খেলে গেছেন। কোন সমস্যাই হয়নি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গত আসরের মতো আবারও মাশরাফি-মাহমুদুল্লাহর মধ্যকারই ফাইনাল যুদ্ধ হয়। তাতে মাশরাফিরই আবার জয় হয়। ফাইনাল এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ হয় যে সেই ম্যাচের ঘোর এখনও কাটছে না। সেই সঙ্গে বিপিএলের ‘ঘোরে’ এখনও আচ্ছন্ন হয়েই আছে বাংলাদেশ।
×