ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্রোহী প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগের বড় বাধা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

বিদ্রোহী প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগের বড় বাধা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রথমে সমঝোতা ও বুঝিয়ে বাগে আনার চেষ্টা। পরে আল্টিমেটাম এবং সবশেষ দল থেকে প্রাথমিক বহিষ্কার। এত কিছু করেও পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহীদের বাগে আনতে পারেনি শাসক দল আওয়ামী লীগ। দল থেকে বহিষ্কার হলেও বিদ্রোহীদের মনোবল ভাঙ্গেনি; বরং তাঁরা পুরোদমে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্রোহী প্রার্থিতার কারণে তৃণমূলে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এসব কারণে অর্ধশতাধিক পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথে কাঁটা বিছিয়েছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাই। বহিষ্কারের পরও বাগে আনতে না পেরে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এখন বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষ নেয়া নেতাকর্মীদের তালিকা প্রস্তুত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারÑ এমন ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ৬৯ জন বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় প্রার্থী তালিকায় নাম থাকলেও ইতোমধ্যে আরও ১৫ মেয়র প্রার্থী নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। আরও অর্ধ শতাধিক বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী নির্বাচনের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে প্রাথমিকভাবে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু বিদ্রোহীদের ধারণা এখন বহিষ্কার করলেও বিজয়ী হলে দল অবশ্যই তাঁদের ফিরিয়ে নেবে। এমন আশা নিয়েই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বিদ্রোহীরা। এ প্রসঙ্গে পৌর নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দলীয় মনোনয়ন না দেয়ার পরও যারা পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তাদের আমরা দলের পক্ষ থেকে বুঝিয়েছি। কিন্তু যারা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনড় রয়েছেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি দল থেকে যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়নি এমন প্রার্থীদের পক্ষে যারা কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে অনেক এমপি-মন্ত্রী স্থানীয় জেলার শীর্ষ নেতাদের মদদের কারণেই অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীকে বাগে আনা যায়নি। কমপক্ষে ২৫ এমপি বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের সহযোগিতা ও মদদ দিচ্ছেন এমন গোপন রিপোর্ট এসেছে দলটির হাইকমান্ডের হাতে। স্থানীয় রাজনীতির হিসাব কষতে গিয়ে ওইসব সংসদ সদস্য দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ না শোনার ভান করে চলেছেন। নিজের অবস্থান সুসংহত করা ছাড়াও ভবিষ্যতের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে রয়েছেন এসব এমপি। ইতোমধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষ নেয়া এসব এমপি ও স্থানীয় জেলার নেতাদের কেন্দ্র থেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হলেও গোপনে তাদের পক্ষেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিস্তর অভিযোগ এসেছে দল মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের কাছ থেকে। জানা গেছে, দীর্ঘ সাত বছর পর নির্বাচনী মাঠে নৌকা বনাম ধানের শীষের লড়াই হচ্ছে। এটিকে মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিলেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাই দলের নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কেননা সারাদেশে আওয়ামী লীগের অনুকূল আসনগুলোতেই দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। যেখানে দল মনোনীত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত ছিল, সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। অনেক স্থানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, আবার বেশিরভাগ স্থানে দলের এমপি বিরোধী জেলার নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বন্দ্বের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। জয়-পরাজয়ের অঙ্কে আওয়ামী লীগের সামগ্রিক রাজনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষ নেয়া নেতাদের তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর পরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ নিয়ে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক নেতাকেই হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কেন্দ্রের অনেক নেতাই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, অতীতে বহিষ্কৃত বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন শেষে দলের পুনরায় ফিরিয়ে আনার দৃষ্টান্তের কারণেই বার বার বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। পৌর নির্বাচনে দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যদি প্রথম থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানের কথা তৃণমূলে জানিয়ে দিতেন তবে আরও অন্তত ৩০-৩৫ বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতেন। অতীতে বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীরা পরবর্তীতে স্বপদে দোদ- প্রতাপে বহাল থাকার কারণেই কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি কোন কাজে আসেনি। বিদ্রোহী প্রার্থিতার কারণে এখন যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের দলে কোনভাবেই ফিরিয়ে না নিলে আগামীতে কেউ আর দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার দুঃসাহস দেখাত না। দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনে সামান্য চিন্তার বলিরেখা ফুটিয়ে তুলতে পারেনি তা বেশ ক’জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। সব বিদ্রোহী প্রার্থীই নিজেদের বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদের কথা ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, দল সঠিক মনোনয়ন দেয়নি। নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণের চাপে প্রার্থী হয়েছি। দল বহিষ্কার করেছে, জনগণ তো বহিষ্কার করেনি। জনগণের প্রার্থী হিসেবেই এখন নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছি। দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না। নির্বাচনে বিজয়ী হলে দল আমাদের পুনরায় বরণ করে নেবে। বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হলে তাঁদের দলে পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া হবে কী না, কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা বেশ ক’জন নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এ ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। মুখে আর ফিরিয়ে নেয়া হবে না বললেও মূল সিদ্ধান্ত নেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এটা জানিয়ে বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের এখন প্রাথমিকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আজীবন দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হবে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে। আজীবন দল থেকে বহিষ্কৃতদের পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া বা না নেয়ার সিদ্ধান্তও আসবে ওই বৈঠক থেকেই। শুধু বিদ্রোহী প্রার্থীই নয়, নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রেও বেশ বেকায়দায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। খোদ খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সাবেক সব মন্ত্রী-এমপি ও সিনিয়র নেতারা সরাসরি দলটির মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালালেও আওয়ামী লীগের কোন মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনী মাঠে নামতে পারছেন না। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির কথা বলে নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানালেও ইসি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান কোন মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারবেন না। ফলে সরাসরি নির্বাচনী মাঠে নামতে না পারায় কারণে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কোন উদ্যোগ নিতে পারছেন না স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিরা। জানা গেছে, সবকিছু বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাগে আনতে তাদের পক্ষ নেয়া নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে। ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা পৌর এলাকায় খোঁজ নিয়ে কারা কারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন গোপনে তার তালিকা তৈরি করছেন। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষ নেয়া নেতারা যতই প্রভাবশালী হোন না কেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগ পিছ পা হবে না, এমনটাই বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
×