ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাঙালীরা ১

সোনার হরিণের আশায় পাড়ি দিয়ে জীবন এখন যন্ত্রণায়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

সোনার হরিণের আশায় পাড়ি দিয়ে জীবন এখন যন্ত্রণায়

রাজুমোস্তাফিজ, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে ॥ মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার যুবক আরমান হোসেন (২৪)। মালয়েশিয়ার রাজধানী শহরের বুকিতবিতান এলাকার ফুটপাথে শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদেই কয়েক মাস আগে রাস্তার পাশে একটি ফলের দোকান দিয়েছিলেন। তার ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় বুধবার রাতে মালয়েশিয়ার পুলিশ আকস্মিক এসে তার ফলের দোকান উঠিয়ে নিয়ে যায়। সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন তিনি। নির্বাক আরমান। নীরব কান্নায় বার বার চোখ মুছছিলেন। জানেন না তিনি এখন কি করবেন। সংসারের অভাব মেটাতে বাড়ির জমি-জমা বিক্রি করে দালালের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা খরচ করে পরিবার-পরিজন ছেড়ে প্রায় এক বছর আগে কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় চলে যান। দালালের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক বছরেও ওয়ার্ক পারমিট মিলেনি। জোটেনি সম্মানজনক কোন কাজ। চোখে মুখে তার হতাশার ছাপ। আরমান জানান, শুধু তার একার এ অবস্থা নয়। তার মতো হাজার হাজার বাংলাদেশী যুবকের একই অবস্থা। এমনিতেই মালয়েশিয়ার মুদ্রা রিঙ্গীতের মান কমে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন প্রবাসীরা। তার উপর নানা হয়রানি, অমানুষিক নির্যাতনসহ নানা ঝামেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন মালয়েশীয় প্রবাসীরা। পূর্ব এশিয়ার একটি আধুনিক রাষ্ট্র মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের মানুষের সেকেন্ড হোম বলে এই দেশটি পরিচিত। প্রায় দুই দশক আগে থেকে কাজের সন্ধানে মানুষ যাওয়া শুরু করে। আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার পেছনে এদেশের লাখ লাখ মানুষের শ্রম আর মেধা কাজ করছে। বাংলাদেশীরা জালান এমবি, জহুরবারু, কেলিংপেন, পেনাং, পুত্রজায়া, কোতারআয়া, কেলাং, বুকিতবিতান এলাকায় বাস করেন। এখানে তারা বিভিন্ন রারার ও পাম্প বাগানে কৃষি কাজ করেন। এছাড়া অনেকে নির্মাণ শ্রমিক আর অনেকে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করেন। আবার অনেকে বিভিন্ন ছোট ছোট দোকান দিয়ে নিজেই ব্যবসা করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলার যুবক সুমন (২৫) জানান, ৭ বছর আগে কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় এসেছি। বহু কষ্টে বুকিতবিতান এলাকায় একটি শপিংমলে কাজ পেয়েছি। মাসে বেতন পাই মাত্র ২২০০ রিঙ্গীত। তাকে সকাল ৯টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। শুধু খাবার জন্য তাদের এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দেয়া হয়। সুমন জানান, প্রবাসীদের বিভিন্নভাবে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা হয়রানি করেন। সহজে দূতাবাস অফিসে ঢুকতে পারেন না। দালালে ভর্তি। দালাল ছাড়া কোন কাজই সম্ভব নয়। তিনি জানান, সরকারীভাবে পাসপোর্ট নবায়ণ খরচ ১১৬ রিঙ্গীত হলেও দালাল নেয় ৫৫০ রিঙ্গীত (১১ হাজার টাকা)। দালালের মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করলে অধিকাংশ সময় তারা টাকা মেরে দিয়ে সটকে পড়ে। দুই বছর আগে তার বাবার মৃত্যুর খবর পেলেও ওয়ার্ক পারমিটের জটিলতার কারণে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারেননি সুমন। এ কষ্টের কথা তিনি আজও ভুলতে পারেন না। দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা প্রবাসী বাঙালীদের নানাভাবে হয়রানি করেন। তাদের কোন অভিযোগ শুনতে চায় না। কুয়ালালামপুরের আমপাং এলাকায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যালয়। বর্তমান রাষ্ট্রদূত মোসলেমা নাসরিন। প্রবাসীবান্ধব দূতাবাস করার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা মালয়েশিয়ায় কোন কাজে আসছে না। কেকে সুপারশপ মার্কেটে ছোট দোকান দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার যুবক মোঃ ফয়সল। বয়স ত্রিশের কোঠায়। ৯ বছর আগে কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় গেছেন। শুরুর দিনগুলোতে চরম কষ্টে কাটান। জীবনের কাছে হার মানেননি ফয়সল। এক সময় শুরু করেন ব্যবসা। মোটামুটি আয় হয়। মালের এক মহিলাকে বিয়ে করে তিনি সুখেই আছেন। ফয়সল জানান, বর্তমানে মালয়েশিয়ার সরকার দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। এ কারণে রিঙ্গীতের মান কমেছে। আগে যেখানে এক রিঙ্গীতে বাংলাদেশী প্রায় ২৫ টাকা পাওয়া যেত এখন সেখানে ১৯ থেকে ২০ টাকা পাওয়া যায়। এখানে বাংলাদেশী মানুষ বেশি আসায় তাদের বেতনও কমে গেছে। প্রতিজন ১২শ’ থেকে ২২শ’ রিঙ্গীত বেতন পাচ্ছে। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তাতে দেশে টাকা পাঠানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কুয়ালালামপুর শহর থেকে প্রায় ৪০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে গেংটিং হাইল্যান্ডের সুবিশাল কমপ্লেক্সে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিক আজাহার (২৮) জানান, মাত্র ১২শ’ রিঙ্গীত বেতন পান। নিজের খরচ মেটানোর পর খুব সামান্য টাকা দেশে পাঠাতে পারেন। আজাহার বলেন, জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি মাত্র। দেশে যাবার জন্য মন প্রায়ই কাঁদে। কিন্তু দেশে গিয়ে কি করব তাই আর যেতে চাই না। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশী প্রবাসীরা পাকিস্তান বিল্ডিং, সুইস গার্ডেন এবং সানকপ্লেসে সবচেয়ে বেশি বসবাস করেন। তাদের দিন কাটে মানবেতর অবস্থায়। ৫টি ঘরে ৫০ জন মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করেন একটি মাত্র বাথরুম। সারাদিন পরিশ্রমের পর তারা নিজেরাই রান্না করে খান। এভাবে কষ্টে চলে তাদের জীবন। যা কেউ কখনও খোঁজ খবর নেয় না। প্রবাসী মানুষরা বর্তমান সরকারের উন্নয়নের কথা বিভিন্ন টিভি এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে প্রতিনিয়ত। তারা চায় এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাক। দেশে যেন আর হানাহানি আর মারামারি না হয় এবং পেট্রোল বোমায় নিরাপদ মানুষ মারা না যায় এ প্রত্যাশা তাদের। তারা শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন তাদের হয়রানি না করেন। দালালের তৎপরতা বন্ধ হয়। বিভিন্ন এজেন্ট যেন অতিরিক্ত টাকা নিতে না পারে। তারা সুন্দর করে বাঁচতে চান তাদের শ্রমের টাকায় যেন দেশ আরও সমৃদ্ধ হয় এই তাদের প্রত্যাশা।
×