ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ ঢাকা-ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য এবারই প্রথম প্রবল দাবি উঠেছে। সে কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে এখন নতুন করে মূল্যায়ন চলছে। এছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়টি আগামী সংসদ অধিবেশনেও উঠতে পারে। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করে ১৯৭১ সালের গণহত্যায় বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা অস্বীকার ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এখন টানাপোড়েন চলছে। এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের কূটনীতিককে তলব ও পাল্টা তলবের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ দাবি করেছে, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর মূলত চারটি বিষয়ে প্রাধান্য পাচ্ছিল। এর মধ্যে রয়েছে, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশে কাছে ক্ষমা চাওয়া, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়া, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ ফিরিয়ে নেয়া ও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের সম্পর্ক বাড়ানো। তবে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়লেও বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে কখনই প্রাধান্য দেয়া হয়নি। এছাড়া বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়া ও পাওনা সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়েও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সে সময়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে চলে আসে। তারপর থেকেই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আরও জোরালো হয়। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করছে ঢাকা। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কেননা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রয়েছে। দুই দেশই এখন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও সংস্থায় একযোগে কাজ করছে। দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে এসব ফোরামেও কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেটাও খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জনতার আদালতে ১৯৫ পাকিস্তানী সেনার গণবিচার করবে। কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের আচরণের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখোমুখি। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তুলেছে কমিটি। এছাড়া সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি তোলা হচ্ছে। এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে ইতোমধ্যেই সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাকিস্তানের কোন অনুষ্ঠানে কোন প্রতিনিধি যাবেন না। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়ে মন্তব্য চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠ’কে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনীতিককে পরস্পর তলবের পর দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশেও এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দাবি জোরালো হচ্ছে। তবে কূটনীতিককে তলব করা সাধারণ বিষয়। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী যে কোন দেশের কূটনীতিককে তলব করা যায়। এতে দোষের কিছু নেই। তবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করাটা ঠিক হবে না বলে তিনি জানান। ওয়ালিউর রহমান বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে দেশটি যেন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়, সে বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা উচিত। এটি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়টি আগামী জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তোলা হবে বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা না চায়, তাহলে আগামী সংসদ অধিবেশনেই বিষয়টি তোলা হবে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমালোচনা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে করা হয়েছে। সে কারণে পাল্টা ব্যবস্থাস্বরূপ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তুলতে চায় সরকার। বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুললে পাকিস্তানকে কিছুটা হলেও চাপে রাখা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শীতল সম্পর্ক চলে এলেও এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে গত ২২ নবেম্বর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে গত ২৩ নবেম্বর দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে সরকার। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এরপর ৩০ নবেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন চলছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা বা নৃশংসতাকে পাকিস্তান অস্বীকার করছে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে দেশটি। পাকিস্তান সরকার একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও ধারণাপ্রসূত হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নৃশংসতার কোন ঘটনা ঘটেনি। আর গণহত্যার ঘটনার জন্য পাকিস্তানের কোন দায় ছিল না। পাকিস্তানের ওপর আনা এসব অভিযোগ সত্য থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও অমূলক অভিযোগ আনছে বলে মনে করে দেশটি। আর এই ঘটনার কারণেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্নের দাবি এখন সামনে চলে এসেছে।
×